ভয় বা চাপে পিছে তাকানোর সময় নেই এগিয়ে যেতে হবে সঠিক ঋণ পরিকল্পনায়
ওয়াসি মাহিন
ঋণ শব্দটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভয়ঙ্কর নেতিবাচক শব্দ। এই শব্দটির সাথে যখন ফাঁদ শব্দটি যুক্ত হয় তখন এর ক্ষমতা এতটাই বেড়ে যায় যে শুধু কোন ব্যক্তি নয় বরং একটি রাষ্ট্রকে ভীত করে দিতে পারে। ভয়কে পাশ কাটিয়ে ঋণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করা যাক। একটি দেশের ঋণ জিডিপি রেশিও হিসাব করলে জাপান, আমেরিকার মত দেশের জিডিপির থেকেও ঋণ বেশি। আবার অনেক দেশ যাদের ঋণ জিডিপির ৬০%-৭০% তাদেরকে দেউলিয়া পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কিন্তু কেন? এর প্রধান কারন হল অদক্ষ ঋণ ব্যবস্থাপনা।
একটা উদাহরণ দেয়া যাক। মনে করুন আপনি ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ করে এমন একটা ব্যবসায় লগ্নি করেছেন। যেই ব্যবসায় লগ্নি করছেন তার আগেই আপনি ব্যবসা থেকে আপনার কি পরিমাণ লাভ হতে পারে, খরচ কত হতে পারে, ব্যাংকের দায় মিটিয়ে আপনার হাতে কি পরিমাণ অর্থ থাকবে সব হিসাব কষেই লাভজনক বিধায় মাঠে নেমেছেন। সেখান থেকে প্রতি মাসে বেশ ভাল একটা মুনাফা আপনি পাচ্ছেন। মুনাফার হার এতই বেশি যে ব্যাংকের ঋণের কিস্তি সুদ সমেত পরিশোধ করবার পরেও আপনার হাতে ভাল অঙ্কের অর্থ থেকে যাচ্ছে।
অপরদিকে অন্য কোন ব্যক্তি একি ব্যাংক থেকে মাত্র ৭ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছে ব্যবসার কথা বলে। কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল তার বাড়ির চার পাশে দেয়াল তুলবে আর বাকি যা অর্থ থাকবে সেটা ব্যবসা করে। কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তার নেই। এরপর কিছু সে ব্যবসায় খাটিয়েছে কিছু অর্থ সে বাড়ির চারপাশে দেয়াল তুলেছে। ব্যবসায় যেহেতু সব টাকা খাটানো হয়নি তাই যে টাকা খাটিয়েছে সেটা থেকে মুনাফার পরিমাণ এতটায় কম যে টাকা লগ্নি করে ব্যাংক কিস্তি দেয়ার টাকা থাকেনা। আবার দেয়াল করা যেহেতু এমন কোন ফলপ্রসু কাজ নয় যেখান থেকে তার আয় বাড়তে পারে, তাই সে নিজের সংসার চালিয়ে ঋণের কিস্তি দিতে গিয়ে বিপদে পড়ে। অবস্থা এমন যে সে যদি কিস্তির সমপরিমাণ টাকা ব্যাংকে দিতে চায় তবে তার বাসায় ভাত রান্না হলেও সাথে কোন তরকারি রান্নার মত অবস্থা থাকে না। এটাই হল হিসাব কষে বিনিয়োগ আর অর্থের অদূরদর্শী ব্যবহারের উদাহরণ। অধিকাংশ মানুষ যারা মন্দ ঋণের চক্রে পড়ে, তার পেছনে কারণ খুজলে ফান্ড ডাইভারশন, মিসিউজ এর প্রমাণ পাওয়া যায়। অথবা যেটুকু ঋণ নেবার সক্ষমতা আছে তার থেকেও অধিক ঋণ নিয়ে অর্থের অদূরদর্শী ব্যবহারের কারনে ঋণ খারাপ হয়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পর থেকে অবাকাঠামোর ঘাটতি রয়েছে। যে পরিমাণ বিনিয়োগ এখানে হবার দরকার ছিল তার কিছুই হয়নি। চোখ বন্ধ করে বাংলাদেশের ম্যাপ কল্পনা করুন। উন্নত দেশের যোগাযোগের সাথে তুলনা করলে এরকম আকারের দেশে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌছাতে সড়ক বা রেল পথে ৬-৭ ঘন্টার বেশি লাগা উচিত নয়। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে এখনো এটা স্বপ্ন। এদেশের প্রধান জাতীয় সড়কগুলি সরু দুই লেনের রয়ে গেছে। পর্যটন নগরী কক্সবাজারে রেলে যাওয়ার সুযোগ নেই। দক্ষিণাঞ্চলের উপক‚ল ঘিরে যেখানে সবথেকে উন্নত শহরগুলো গড়ে উঠার কথা সেখানে রেলের সংযোগ নেই। সেতু নেই।
কৃষিতে ভাল প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি নেই। সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। বন্দর বিবেচনায় সত্যিকারের সমুদ্রবন্দর একটিও নেই। কর্ণফুলী নদীতে গড়ে উঠা চট্টগ্রাম বন্দরকেই সক্ষমতার সবটুকু ব্যবহার করে কন্টেইনার জট মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
ঢাকাকে বলা হয় ভবিষ্যতে বিশ্বের সবথেকে বড় মেগাসিটি। অথচ এখানে পর্যাপ্ত রাস্তা নেই, আধুনিক পয়:নিস্কাশন নেই। পানি অপসারণের পথ নেই। এই যে নেই এর মিছিল এটার কারণ বিগত ৫০ বছরে অবাকাঠামো খাতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ আমাদের প্রয়োজন ছিল সেটা না করা। সমস্যাগুলি পুঞ্জিভ‚ত হতে হতে আজকের বাংলাদেশ। এসব সমস্যার সমাধানের অনেকগুলো প্রকল্প নেয়া হয়েছে, কিছু চলমান। তবে মোটেও সেটা ৫০ বছরের ঘাটতি মেটাতে যথেষ্ট নয়। কিন্তু এত বিনিয়োগের জন্য আমাদের ঋণ করা জরুরি। কিন্তু ২০২৬ সালে স্বল্পউন্নত দেশ থেকে চ‚ড়ান্ত ভাবে বের হয়ে গেলে আমরা সল্পখরচের ঋণ থেকে বঞ্চিত হব। আমাদের হাতে আছে ৪ বছর। গুরুত্বপূর্ণ সব অবাকাঠামোর ঘাটতি আমাদের এখনি মেটাতে হবে। ২০২৬ এর পর ঋণ করলে সুদের হার ও বেড়ে যাবে। খরচ ও বাড়বে। তাই এই মুহুর্তে ভীত না হয়ে এগিয়ে চলা দরকার। বাংলা একসময় বিশ্বের জিডিপির বিশাল অংশের যোগান দিত। শত বছরের বঞ্চনা, শোষণে আজ এদেশ পিছিয়ে পড়া দেশের কাতাঁরে। এখন সুযোগ আসছে। কারো ভয় দেখানো বা চাপে পিছে তাকানোর সময় নেই। এগিয়ে যেতে হবে সঠিক পরিকল্পনায়।
বাংলাদেশে অনেক সমস্যা রয়েছে। দুর্নীতি, অযাচিত প্রকল্প ব্যয় (বালিশ, চামুচ), প্রকল্প বাস্তবায়নের অনভিজ্ঞতা, দীর্ঘসূত্রীতাসহ প্রচুর সমস্যা আমাদের রয়েছে। এর প্রতিটি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। তবে আপাতত দেশটাকে দাড় করাতে গেলে আবকাঠামো ও বেসিক সমস্যা সমাধানে যে বিনিয়োগ দরকার সেটার জন্য ঋন করতেই হবে, যেহেতু এত বিশাল বিনিয়োগ নিজেদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। ভীয়েতনাম আজকের এই অবস্থানে এসেছে ঋন করেই। দেশটি নিজেদের এতটায় বিনিয়োগ উপযোগী করে তুলেছে যে সারা বিশ্বের বিনিয়োগ গন্তব্য ভীয়েতনাম।
বাংলাদেশকে বিনিয়োগ উপযোগী করে তুলতে হবে। চট্টগ্রাম সৈকত জুড়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলেও এভাবে বিনিয়োগ উপযোগী করার জন্য সাউথ সাউথ করিডোর প্রকল্পে বিনিয়োগ প্রয়োজন। দেশের রেল নেটওয়ার্ক এর বিস্তৃতি প্রয়োজন, সংস্কার প্রয়োজন।
সবথেকে বেশি প্রয়োজন ফেন্সি/বিলাসী প্রকল্প না নেয়া।টাকার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এখন অবাকাঠামো বিনিয়োগ বিলাসিতা নয় বরং চাহিদা। এসব বিনিয়োগের রিটার্ন কেমন আসতে পারে সেগুলা ভেবে প্রয়োজনে সাপ্লিমেন্টারী প্রকল্প নিতে হবে। যেমন মাতারবাড়ি বন্দরের সাথে ইকোনমিক জোন করা হচ্ছে। পায়রা বন্দরের সাথে ইকোনমিক জোন করা হচ্ছে। এগুলা প্রকল্পের রিটার্ন নিশ্চিত করে।
২০১৯-২০ এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের যত বিদেশি ঋণ আছে এর ৩৮% বিশ্বব্যাংকের, ২৪.৫% এডিবির, ১৭% জাইকার এবং চীনের ৬.৮১%। কিন্তু এতেই চীন নিয়ে ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা অপ্রয়োজনী প্রকল্পে ঋণ না নিলে আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের সরকারি বৈদেশিক ঋণ মোট ৬৭ বিলিয়ন ডলার। এর ভেতর ২.৬২ বিলিয়ন ডলার সল্প মেয়াদী ঋণ বাদে বাকি অংশ দীর্ঘমেয়াদী ঋণ। সল্প মেয়াদী ঋণের অংশ জিডিপির ১% এর নিচে। অথচ ভারতের সল্প মেয়াদী ঋন ২০২১ সালের হিসাবে তাদের জিডিপির ৩.৮%। কিন্তু তাদের কাছ থেকেই আমাদের জন্য সতর্ক হবার পরামর্শ এসেছে। মূলত ঋণের ঝুঁকির ক্ষেত্রে ৩০ বিলিয়ন ডলার ও বড় ঝুঁকির কারণ হতে পারে, আবার ২০০ বিলিয়ন ডলার ও দুশ্চিন্তার কারণ নাও হতে পারে। পুরো বিষয়টা নির্ভর করে ডেট ম্যানেজমেন্টের উপর। আর এজন্যই জাপানের মত দেশের জিডিপির থেকেও ঋণ বেশি থাকা সত্তে¡ও কেউ বলছে না জাপান দেউলিয়া হয়ে যাবে। কিন্তু শ্রীলংকার ক্ষেত্রে সেটি বলা হচ্ছে।
সম্ভবত ২০২৬ এর পর ঋণের প্রাইসিং বেড়ে যাবে। ২০২৬ এর পর প্রকল্প হাতে নিলে সেটার খরচ বাড়বে আরো বেশি। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প না নিয়ে দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘ মেয়াদের স্ট্রাটেজিক প্রকল্পের ফান্ডিং এখনি নিশ্চিত করার সময়। অযাচিত প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির জন্য কার্যকরী জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। জবাবদিহি না থাকলে দুর্নীতি বন্ধ করার সুযোগ নেই। কাউকে দায়িত্ব দিলে তার কাছ থেকে সঠিক সময়ে কাজ আদায়ের কার্যকরী পন্থা নিতে হবে। হুট করে কোন চুক্তি না করে অবশ্যই দেশের সল্পমেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদে স্বার্থ সুরক্ষিত হয় এমন চুক্তি করতে হবে। সেচ্ছাচারীতা বন্ধ করতে হবে। আমাদের হাতে সময় বেশি নেই।
সতর্ক আমাদের হতেই হবে অর্থের সঠিক ব্যাবহারের ক্ষেত্রে। আর যদি সেটা নিশ্চিত করা যায় তবে দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে শক্ত অবস্থায় পৌছাতে অবাকাঠামোর ঘাটতি কাটিয়ে উঠা লাগবে। বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত করতে হবে দেশকে। এতে দারিদ্র দূর হবে, অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত হবে সেই সাথে রাজনৈতিকভাবে বিশ্বের সপ্তম জনবহুল দেশের গলার জোর আরো বাড়বে বলে আশা রাখি।