
দেশে বিদেশি কর্মী বৃদ্ধির কারণ কি আমাদের মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব?

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
‘দেশে ১ বছরে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে ৮৭ শতাংশ’Ñ ডেইলি স্টার। দক্ষ জনশক্তি, বিশেষ করে শীর্ষ ও মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপকের চাহিদা পূরণে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৫ হাজার ১২৮ বিদেশির ওয়ার্ক পারমিট অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এটি আগের বছরের তুলনায় ৮৭ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি। তারা কারা? তারা হলেন শীর্ষ ও মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপক, যাদের উচ্চ বেতন দিতে হয়। মধ্যপ্রাচ্যে আমরা সাধারণত শ্রমিক শ্রেণির কর্মী পাঠাই। যারা খুব সামান্যই উপার্জন করেন। অনেক শ্রমিক মিলে যতো উপার্জন করেন, শীর্ষ পর্যায়ের একজন বিদেশি ব্যবস্থাপক তা একাই উপার্জন করে দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিজ দেশে নিয়ে যান। এটা খুবই এলার্মিং সংবাদ। এর কারণ অনুসন্ধান সাপেক্ষে ধঢ়ঢ়ৎড়ঢ়ৎরধঃব সবধংঁৎব নেওয়া খুবই জরুরি।
কোনো গবেষণা ছাড়াই কেবল একটু কমনসেন্স ব্যবহার করেও বলে দেওয়া যায়, এর মূল কারণ শিক্ষার মান। আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। নেই সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত মানুষেরও। এই সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিতের একটা বিশাল অংশ বিসিএস নামক মাদকে আসক্ত। লক্ষ লক্ষ যুবক যুবতী এই আশায় দিন রাত গাইড নামক চটি বই মুখস্তে ব্যস্ত। তারা বিসিএস চাকরির সুবিধা ও ক্ষমতা দেখে এর মোহে আচ্ছন্ন। চাকরির যে ডাইভারসিটি আছে সেই সুযোগ তারা নেয় না। তারা ভালো পাত্র বা পাত্রী হতে চায়। যে চাকরিতে যতো বেশি দুর্নীতির সুযোগ সেই চাকরির পেছনে তারা ছুটে বেশি।
লক্ষ্য করলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে বিসিএস শিক্ষাও বিসিএস ক্যাডার। অধিকাংশের এই চাকরির প্রতি কোনো মোহ নেই। আছে ট্যাক্স, পুলিশ ও প্রশাসনে। এমনকি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারও এই মোহে আচ্ছন্ন। হবে না কেন? চ্যানেল ২৪-এ দেখলাম আমাদের গুণধর প্রশাসন ক্যাডারের পদস্থ কর্মকর্তাগণ সরকারের কাছে নির্বাচনকে সামনে রেখে ৩৮০ কোটি টাকার বিলাসবহুল স্পোর্টস কার কিনতে আবদার জানিয়েছে। তারা জানে সামনে নির্বাচন এবং বø্যাকমেইল করার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। অথচ দেশ এখন একটা অর্থনৈতিক ক্রাইসিসের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের উপর সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিজ টাকায় বিদেশ ভ্রমণে পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা আছে। আর ঠিক এই সময়ে তারা বিলাসবহুল গাড়ি চেয়েছে। তাদের কর্মকাÐ দেখে বোঝা যায়, উনারা দেশের কথা ভাবেন না। কারণ বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার সময় থেকেই তারা মোহাচ্ছন্ন। সেই থেকে এরা আর বের হতে পারছে না।
আমাদের বিসিএস পরীক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে না সাজালে এই অবস্থা থেকে মুক্তি নেই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে না সাজালে এই অবস্থার আরও অবনতি ঘটবে। নতুন যে কাররিকুলাম সরকার চালু করতে যাচ্ছে, এটার মাধ্যমে যে প্রোডাক্ট বের হয়ে আসবে, সেটা তো আরও ভয়াবহ রকমের খারাপ হবে। তখন এ দেশের সকল বেসরকারি উচ্চ পদগুলো দখল করে নিবে বিদেশিরা। এমনিতেই দেশে ঘুষ, দুর্নীতি চলছে ফ্রি স্টাইলে। আবার ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সেই অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে পাচার হয়ে। এই খারাপ শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও যতগুলো মেধাবী আমরা তৈরি করছি তারাও বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এসব যদি না হতো তাহলে বাংলাদেশ আজ কত উন্নত হতো বুঝতে পারছেন? আমাদের শত্রæ আমরাই। ব্রিটিশরা বা পাকিস্তানিরা আমাদের ভালো করেনি বা করতে চায়নি মানা যায়। কিন্তু আমরা? আমরা এমন কেন?
এ দেশের সকল সমস্যার মূল হলো শিক্ষার সমস্যা। এটাকে যতদিন আমরা সমাধানের চেষ্টা করব, আর আর সবকিছুর ফল জিরো সাম-রুলের মতো মানে ফলাফল শূন্য। এই যে প্রতি বছর এই সময় আসলে আমরা ডেঙ্গু আতঙ্গে ভুগি, সেই আতঙ্ক মৌসুম শেষ হলে ভুলে যাই। যখন আতঙ্ক আসে ওষুধ ছিটাই বা নানারকম চোখে পড়ার মতো উদ্যোগ নেই। বিষ ছিটিয়ে যে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব না এই ন্যূনতম জ্ঞানটুটকুও আমাদের নেই। বিষ ছিটাতে গিয়ে উপকারী অনেক কীটপতঙ্গের জীবনও আমরা বিপন্ন করে ফেলছি ঠিক যেমন জমিতে বিষ ছিটিয়ে আমরা দেশি মাছের অনেকগুলোকেই বিলুপ্ত করে ফেলেছি।
বিষ ছিটালে যেই মশাগুলো বেঁচে যায় সেগুলো আরও শক্তিশালী হয়। পরবর্তী সময়ে তারা বিষ রেজিস্টেন্ট হয়ে যায়। কলকাতা কীভাবে ডেঙ্গু সমস্যার সমাধান করলো? পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাই একমাত্র পথ। এইটা কেবল সত্যিকারের শিক্ষায় শিক্ষিত জনগুষ্টিই পারে মানতে। এছাড়া ঘুষ, দুর্নীতি ও অন্যান্য সমস্যার সমাধানের মূলেও শিক্ষা। প্রতিবছর শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ কমাবেন আর আপনারা চাইবেন সুন্দর উন্নত দেশ। শিক্ষকদের বেতনে সম্মানে মারবেন আর আপনারা চাইবেন সভ্য উন্নত দেশ। সত্যিই সেলুকাস। কী বিচিত্র এই দেশের প্রশাসক ও পরিচালকদের ভাবনা।
লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
