কীভাবে বিদেশে টাকা পাচার হয়? কারা করে?
ওয়াসি মাহিন
অনেকের ধারণা টাকা মনে হয় ব্রিফকেসে ভরে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। বিষয়টা এমন নয়। এর প্রধান দুটি উপায় হচ্ছেÑ আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিং। আর ব্যবসার মাধ্যমে নামে বেনামে আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে ডলার বিদেশে পাচার করা হয়। এই দুটি বাদে বাকি যে উপায়ে অর্থ পাচার হয় সেটার পরিমাণ খুব সামান্য। যেমন শিক্ষার খরচ মেটানোর জন্য ডলার পাঠিয়ে দেওয়া। কিন্তু এক্ষেত্রে লিমিট থাকে, তাই খুব অংকের অর্থ এভাবে পাচার সম্ভব নয়। রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা খুব নিখুঁতভাবে কাজটি করে থাকেন।
আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ সত্যি খুঁজতে চায় না। যেই ব্যাখ্যাটি যার যার রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে মিলে যায় সে খুশি। না মিললে দালাল। আর এই একটা কারণেই আমরা কোনো রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী ব্যক্তি খারাপ কাজ করলে তাকে বৈধতা দিই। তারা পার পেয়ে যায়। আড়ালে থেকে যায় আসল অপরাধী এবং তার অপরাধনামা। যেমন ধরুন বিরোধী দলের নামে কোনো দুর্নীতি মামলা হলে সেটি হবে রাজনৈতিক মামলা। এখন সেটা যদি সরকারি দল কখনো বিরোধী দল হয় তখনো প্রযোজ্য।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গেøাবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি কেবল ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ থেকে চার প্রক্রিয়ায় ৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। যা প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমান। এ টাকার বেশিরভাগ বৈদেশিক বাণিজ্যে জালিয়াতির মাধ্যমে পাচার করা হয়। একই পদ্ধতিতে একই বছর দেশে ঢুকেছে ২ শ’ ৩৬ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। এই যে দেশে ২৩৬ কোটি ডলার ডুকেছে এই বিষয়টি একটু মাথায় রাখবেন। পরবর্তী আলোচনার সাপেক্ষে এটি গুরুত্বপূর্ণ।
কীভাবে এই অর্থ পাচার হয়েছে : সব সরকার করেছে। এই টাইপ একটি সহজ উত্তর দিতে পারলে আমাদের দেশের মানুষগুলোর জন্য সুবিধা হতো। কারণ তারা গভীরভাবে ভাবে না। যেটার ট্রেন্ড চলে সেটাই ফলো করে। তাহলে আসুন একটু জেনে নিই এই অর্থ কীভাবে পাচার করা হয় সেই সম্পর্কে। জিএফয়াই-এর হিসাব মতে, বৈদেশিক বাণিজ্যের অসংগতি বিবেচনায় নিয়ে একটি রিপোর্ট করা হয় যেখানে উন্নয়নশীল দেশ থেকে গত দশ বছরে প্রায় ১০০০ বিলিয়ন বা ১ ট্রিলিয়ন অর্থ পাচারের চিত্র উঠে আসে। বাংলাদেশ থেকে প্রধান দুটি উপায়ে অর্থ পাচার হয়ে যায়। একটা হলো আমাদানি অন্যটা রপ্তানি। একটি উপায় হচ্ছে, পণ্য আমদানির সময় কাগজপত্রে বেশি দাম উল্লেখ করে টাকা পাচার, আরেকটি হচ্ছে, পণ্য রপ্তানি করার সময় কাগজপত্রে দাম কম দেখানো।
মনে করুন, আপনি ১০০ ডলারের পণ্য আমদানি করবেন। অর্থাৎ যে পণ্য আমদানি করবেন সেটির প্রকৃত মূল্য হল ১০০ ডলার। কিন্তু আপনি চাইছেন বিদেশে টাকা পাচার করতে। তখন আপনি আমদানির এলসি সহ অন্যান্য কাগজপত্র সিস্টেম করে দাম দেখালেন যে পণ্যটি আমদানি করতে চান সেই পণ্যের মূল্য $১৫০ ডলার। যখন এলসি নিষ্পত্তি হলো আপনি সুন্দর মতো বিদেশে $১৫০ ডলার পাঠিয়ে যার কাছ থেকে পণ্য কেনার কথা তাকে $১০০ ডলার দিয়ে দিলেন। বাকি $৫০ ডলার আপনি বিদেশে পাচার করে ফেললেন। রপ্তানির সময় কম দাম দেখানোর ফলে বিদেশি ক্রেতারা যে অর্থ পরিশোধ করছে, তার একটি অংশ বিদেশেই থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আসছে শুধু সেই পরিমাণ অর্থ, যে পরিমাণ অর্থের কথা দেখানো হচ্ছে। অর্থাৎ কাগজপত্রে যে দাম উল্লেখ করা হয়েছে সেটা।
যেমন ধরুন, আপনি আপনি যে পণ্য রপ্তানি করবেন তার প্রকৃত বাজার মূল্য হলো $১০০ ডলার। কিন্তু আপনি রপ্তানির ডকুমেন্টে উল্লেখ করলেন যে আপনি মাত্র $৫০ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন। তাহলে বিদেশ থেকে যিনি আপনার পণ্য ১০০ ডলারে কিনবে তিনি আপনাকে এলসি এর মাধ্যমে $৫০ ডলার দিল। আর বাকি $৫০ ডলার আপনি তাকে বললেন বিদেশের কোন ব্যাংকে আপনার একাউন্টে জমা করে দিতে।
এদিকে আমাদের দেশের ডকুমেন্টস অনুযায়ী। কিন্তু ওই ৫০ ডলারের উল্লেখ থাকবে। আমদানি বা রপ্তানি সহজ কোনো পদ্ধতি নয়। এই সিস্টেমে অনেক ম্যারপ্যাচ থাকে। আমদানি বা রপ্তানি পণ্যের সঠিক বাজার মূল্য কতো এটা নিরুপন করা সহজ কোনো কাজ নয়। ব্রান্ড ভ্যালুর কারণে একই পণ্যের দাম একেক রকম হতে পারে। তাই সরকারের পক্ষ্যে চাইলেও এটা রোধ করা সম্ভব হয় না। বুঝছি এবার পাবলিকের মন্তব্য হবে আমি সরকারের দোষ ঢাকতেছি। ভাবুন ভাই। তবে কিছু উদাহরণ দিয়ে নিই। তাহলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে।
২০১৫ সালে টাকা পাচারে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে মেক্সিকো। ওই দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৪ হাজার ২৯০ কোটি ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মালয়েশিয়া থেকে ৩ হাজার ৩৭০ কোটি ছাড়াও ভিয়েতনাম থেকে ২ হাজার ২৫০ কোটি, থাইল্যান্ড ২ হাজার ৯০ কোটি, পানামা ১ হাজার ৮৩০ কোটি এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে ১ হাজার ৫৪০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। এই সব দেশ আমাদের থেকে দূর্নীতি সূচকে যথেষ্ট এগিয়ে রয়েছে। তবুও তারা টাকা পাচার আটকাতে পারেনি। যেমন ধরুন মালয়েশিয়ার $৩৩.৭০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে ২০১৫ সালে। সেখানে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫.৯ বিলিয়ন ডলার? আমাদের এক দশকে বিদেশে টাকা পাচার হয়েছে প্রায় $৬৩ বিলিয়ন আর ভারতের হয়েছে $৪৪০ বিলিয়ন।
অর্থপাচারেরথইতিহাস : জিএফয়াই সংস্থাটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অর্থ পাচারের একটি চিত্র তুলে ধরেছে। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের মোট আমদানি ছিল $১৪.৮ বিলিয়ন। এবং রপ্তানি ছিল $১০.১ বিলিয়ন। আমদানি রপ্তানি মিলিয়ে মোট বৈদেশিক বাণিজ্য ছিল $২৪.৯ বিলিয়ন। এই $২৪.৯ বিলিয়নের ভেতর $৪.২৬ বিলিয়ন ডলার পাচার করা হয়েছিল। সেই সময়ের হিসাবে মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ১৮.৪৭% টাকা পাচার হয়ে যায় উপরিউক্ত উপায়ে।
২০১৫ সালে বাংলাদেশের আমদানি ছিল $৪০.৬৯ বিলিয়ন এবং রপ্তানি ছিল $৩২.২ বিলিয়ন ডলার। মোট বৈদেশিক বাণিজ্য ছিল $৭২.৮৯ বিলিয়ন ডলার? এর ভেতর উপরিউক্ত উপায়ে মোট পাচার হয়েছে $৫.৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৮.০৯% টাকা পাচার হয়েছে। হ্যা। টাকার হিসাবে এটি প্রায় ৫০,০০০ কোটি টাকার সমান। কিন্তু আমি ২০০৫ সালের হিসাব টেনেছি একারনে যে তুলনামূলক একটি পর্যালোচনা করে দেখতে। সেখানে দেখতে পাচ্ছেন যে অর্থ পাচার ১৭.৪৭% থেকে কমে ২০১৫ সালে ৮.০৯% এ দাড়িয়েছে।
কারা পাচার করে? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর বাংলাদেশিদের জন্য হলো সরকার। যদি এই দাবি করি তাহলে প্রচুর সংখ্যক মানুষ হাততালি দিবেন আর বলবেন সবডি চোর। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমি এমন কোনো উত্তর দিতে পারছি না। এই টাকা পাচারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এদেশের ব্যবসায়ীরা। যারা রাজনীতিবিদ ও বড় বড় আমলাÑ তারাও এই ব্যবসায়ীদের সাথেই আঁতাত করে পাচার করতে পারে। তাদের ভেতর আওয়ামী সমর্থক ও বিএনপি সমর্থকও রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক ট্যাগ দিলে তখন এসব পাচারকারীদের সুবিধা হয়। রাজনৈতিক ট্যাগ দিলে বিষয়টা হালকা হয়ে যায়। একপক্ষ অস্বীকার যায়, আরেক পক্ষ খুশি হয়। যত করাপ্টেড রাজনীতিবিদ হোক না কেন, তার নামে যত মামলা অভিযোগ থাকে ততো তাদের পোর্টফলিও ভারি হয়। যেভাবেই অভিযোগ করেন না কেন, তারা সাধারণত মামলা প্রæফ। মানে তাদের বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযোগ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত মামলায় রূপ নেয়। এটাই হয়ে আসছে, চলছে। ভবিষ্যতেও হয়তো চলবে। ব্যবসায়ী বাদে অন্য সকল পেশার লোকজন যখন টাকা পাচার করতে চান, চ্যানেল কিন্তু এই ব্যবসায়ীরাই। কেউ আমদানি রপ্তানিকারক ব্যবসা, অথবা কেউ হুন্ডি ব্যাবসার মাধ্যমে পাচার করে।
শুধু যে ব্যবসায়ীরা যুক্ত তেমন নয়। এদেশে ব্যবসারত বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও রয়েছে, যারা আমদানি-রপ্তানিতে কারসাজি করে অর্থ পাচার করে থাকে। তবে অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এসব ব্যবসায়ীদের ব্যবহার করে বিদেশে টাকা জমানোর উপায় হিসাবে ব্যবহার করে। পরিতাপের বিষয় হলো, বর্তমানে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ বেশি মাত্রায় বেড়েছে। আর এভাবেই হল মার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রæপের মতো স্ক্যান্ডাল ঘটেছে। যেখানে তারা নামে বেনামে বিভিন্ন কোম্পানির নামে হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করেছে।
উত্তোরণের উপায় : আপাতত আমার ঝুলিতে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের কোনো উপায় নেই। মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি দেশেই এটা একটা প্রকট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মালয়েশিয়ার মতো দেশ থেকে $৩৩ বিলিয়ন ডলার বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের কিছুই করার নেই। আসলে এই বিষয়ে করার মতো অপশনও কম। কারণ আগেই বলেছি, আমদানি বা রপ্তানি পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপন করা খুব সহজ এবং চোখ ফাঁকি দেওয়াও সহজ। তবে একটি কাজ করা যেতে পারে। উপরের একটি অংশে আপনাদের মাথায় রাখতে বলেছিলাম। সেটি হলো ২০১৫ সালে এদেশ থেকে ৫.৯ বিলিয়ন ডলার যেমন পাচার হয়ে গেছে ঠিক তেমনি ২.৩৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশ থেকে পাচার হয়ে ঢুকেছে। আমরা যদি বাংলাদেশকে বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় স্থান হিসাবে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে হয়তো আমাদের দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থের পরিমাণের চেয়ে বিদেশ থেকে পাচার হয়ে আসা অর্থের পরিমাণ বেশি হবে? আমাদের দরকার দেশে সেরকম বিনিয়োগ উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা।
একটি উদাহরণ এখানে আমরা কাজে লাগাতে পারি। মালয়েশিয়া তাদের অর্থ পাচার রোধ করতে পারেনি। বিকল্প হিসাবে তারা তাদের দেশে সেকেন্ড হোম প্রজেক্ট চালু করেছে। বিদেশ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সেদেশের আবাসন সহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করলে তাকে নাগরিকত্ব দেওয়াসহ বিশেষ কিছু সুবিধা দিচ্ছে। অবাক হবার মতো বিষয় হলো, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম স্কিমে সব থেকে বেশি বিনিয়োগ করা দেশগুলোর ভেতর বাংলাদেশ একটি। আমাদেরও এরকম কিছু করতে হবে যেন এদেশ থেকে টাকা বাইরে যাবার পরিবর্তে এদেশে বিদেশ থেকে টাকা আসে।
লেখক: ব্যাংকার