বিশ্বে এমন একটি দেশও কি আছে, যে দেশ আগে শিক্ষা এবং গবেষণায় উন্নতি না করে উন্নত দেশ হয়েছে?
অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
সীমান্ত স্কয়ারের সিনেপ্লেক্সে ‘ওপেনহেইমার’ ছবিটি দেখলাম। সঙ্গে ছিলো স্ত্রী ডোনা, কন্যা লিলিয়া এবং বন্ধু প্লাস সহকর্মী ঊঊঊ এর শিক্ষক মাইনুল। দেখার পর আমার প্রথম অভিব্যক্তি হলো, এই ছবিটি আমাদের প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সকল সদস্যের দেখা উচিত। এমনকি বাংলাদেশের সকল রাজনীতিবিদ। আমলাদেরও দেখা উচিত। ছবিটি দেখলে তারা বুঝতে পারবেন, শিক্ষা ও গবেষণার মূল্য কী। শিক্ষা ও গবেষণার জন্য কেমন পরিবেশ দিতে হয়। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটাতে যেমন একটা নির্দিষ্ট সময়। পরিবেশ দিতে হয় তেমনি গবেষণার জন্যও চাই রহপঁনধঃরড়হ এর পরিবেশ। পুরো সিনেমাজুড়ে পদার্থবিজ্ঞানীরা কেমন করে কথা বলে, কেমন করে চলে, কীভাবে ভাবে ইত্যাদি অনেককিছু শিক্ষার আছে।
খোদ ওপেনহেইমারের জীবনী থেকে অনেক কিছু শিক্ষার আছে। ওপেনহেইমার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৫ সালে রসায়নে আন্ডারগ্রাজুয়েট করেছে। তারপর ১৯২৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করেছে। একটি বিষয় লক্ষ্য করুন। রসায়নে ব্যাচেলর করে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করতে একটুও সমস্যা হয়নি। আর রসায়নে ব্যাচেলর করে পদাথবিজ্ঞানে পিএইচডি করায় তার পদার্থবিজ্ঞানী হওয়া নিয়ে কেউ কোনোদিন প্রশ্ন করেনি। তার ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হয়নি। আমাদের দেশে কি রসায়নে ব্যাচেলর করে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করতে দিবে? দিলেও তার পিএইচডি শেষে পদার্থবিজ্ঞানে শিক্ষক হিসাবে নিবে? তাকে না নিবে রসায়ন বিভাগ। কারণ তার পিএইচডি পদার্থবিজ্ঞানে আবার না নিবে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ। কারণ তার আন্ডারগ্রাজুয়েট ডিগ্রি রসায়নে।
একটা উদাহরণ দিই। আমাদের ড. মাহবুব মজুমদার এমআইটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আন্ডার গ্রাজুয়েট করে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করেছে ইম্পেরিয়াল কলেজে পোস্ট-ডক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে দরখাস্ত করেছিলেন। তার আন্ডার গ্রাজুয়েট ডিগ্রি পদার্থবিজ্ঞানে না বিধায় তাকে নেওয়া হয়নি। সেদিন তাকে নিলে আজকে তার ক্যারিয়ার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা দুটোই ভিন্ন হতে পারতো।
ওপেনহেইমার ব্যাচেলর করে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে এসেছিলো। প্রথমে বিখ্যাত জঁঃযবৎভড়ৎফ এর কাছে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে লিখেছিলেন। ওপেনহেইমারের জন্য লেখা রেকমেন্ডেশন লেটার দেখে জঁঃযবৎভড়ৎফ আগ্রহ পাননি। কারণ সেই লেটারে লেখা ছিলো ওপেনহেইমার এক্সপেরিমেন্টে খুবই পষঁসংু! পরে ঔ ঔ ঞযড়সংড়হ তাকে নেয়। কিন্তু সেখানে সে যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে কোনো উৎসাহ পেতেন না। আস্তে আস্তে তিনি মানসিক রোগীতে পরিণত হন। তিনি তার অধ্যাপকের উপর এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন যে শিক্ষকের আপেলের মধ্যে বিষ মিশিয়ে রাখেন। সৌভাগ্যববসত সেই শিক্ষক সেটা খায়নি। ওপেনহেইমারের বাবা-মা অত্যন্ত ধনী এবং বনেদি পরিবারের হওয়ায় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে কনভিন্সড করতে পেরেছিলেন যে ওপেনহেইমারকে যেন বহিষ্কার না করা হয়। পরে সেখানকার এক অধ্যাপকের পরামর্শে ওপেনহেইমার জার্মানির গোটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। টহরাবৎংরঃু ড়ভ এস্খঃঃরহমবহ-এ গিয়ে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের এক দিকপাল ম্যাক্স বর্ণের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান। সেখানে গিয়ে ছাত্র হিসাবে যাদের ওখানে পান তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঐবরংবহনবৎম, ঔড়ৎফধহ, চধঁষর, উরৎধপ, ঋবৎসর এবং ঞবষষবৎ. বুঝতে পারছেন কি রকম পরিবেশ? সেখানে গিয়ে বুঝতে পারলেন লেখাপড়ার এমন পরিবেশই তিনি খুঁজছিলেন। ম্যাক্স বর্ণের তত্ত¡াবধানে থেকে পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি তার ভালোবাসা অনেকগুন বেড়ে যায়। তার উপর ঐবরংবহনবৎম, ঔড়ৎফধহ, চধঁষর, উরৎধপ, ঋবৎসর এবং ঞবষষবৎ দের পাওয়া ছিলো বোনাস। পৃথিবীতে এর চেয়ে বেটার জায়গা ওপেনহেইমার আর আশা করতে পারেননি। ম্যাক্স বর্ণই তার ক্যারিয়ারকে চেঞ্জ করে দেয়। তার লেখাপড়া কতোটা ইন্টেন্স ছিলো তার প্রমাণ মাত্র ২ বছরের কম সময়েই পিএইচডি শেষ করে ফেলেন। এই সময়ের মধ্যে অনেকগুলো ভালো কাজ করেন। এরপর তিনি আমেরিকায় ফিরে যান। সেখানে গিয়ে টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঈধষরভড়ৎহরধ, ইবৎশবষবু-র পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পান এবং ১৯৩৬ সালেই মাত্র ৩২ বছর বয়সে সেখানে পূর্ণ অধ্যাপক হয়ে যান। টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঈধষরভড়ৎহরধ, ইবৎশবষবু-র পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের পূর্ণ অধ্যাপক হওয়ার ৬ বছর পরে ১৯৪২ সালে তিনি ম্যানহাটন প্রজেক্টের ডিরেক্টর হিসাবে নিয়োগ পান। কাকে কী দায়িত্ব দিতে হবে সেটা করতে আমেরিকা যে ভুল করে না তার একটা বড় প্রমাণ ছিলো এই নিয়োগ। তাকে নিয়োগ না দিলে পৃথিবীর ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো। তারা ওপেনহেইমারের মধ্যে পদার্থবিদ হিসাবে মেধার পাশাপাশি নেতৃত্বগুণও দেখেছিলেন। এখানেই বাংলাদেশ চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কেবল দলান্ধতা দেখা হয়। এটি ৭৫ এর পরে যারাই ক্ষমতায় এসেছেন তারাই এটি করেছেন এবং সময়ের সঙ্গে তার মাত্রা বাড়তে বাড়তে আজ সেটা চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে একাডেমিক যোগ্যতাকে একটুও মূল্যায়ন করা হয় না। যিনি একাডেমিকসদের নেতৃত্ব দিবেন তার যদি ন্যূনতম ভালো মানের একাডেমিক যোগ্যতা না থাকে তিনি কীভাবে শিক্ষকদের বলবেন আপনারা ভালো গবেষণা করুন, কীভাবে শিক্ষায় গবেষণার মূল্য বুঝবেন? ওপেনহেইমারের নেতৃত্বেই আমেরিকায় লস আলমাস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি তৈরি করা হয়। আর সেখানেই পারমাণবিক বোমা বানানো হয় এবং সেখানেই ছোট স্কেলে পরীক্ষা করা হয়। ওপেনহেইমারের চরিত্রের দৃঢ়তা, তার অতীত মানসিক রোগী হওয়া সবকিছুই প্রমাণ করে তিনিই ছিলেন রাইট পারসন। আমার দৃষ্টিতে ওপেনহেইমার বড় মাপের আদর্শ বিজ্ঞানী ছিলেন না। সেই সময়ে ওপেনহেইমারের চেয়েও বড় বড় বিজ্ঞানী আমেরিকাতে ছিলো কিন্তু আমেরিকার সামরিক বাহিনী তাকেই নির্বাচন করেছে। সে বিজ্ঞানী হয়েও জেনারেলদের কম্যান্ড মানতে তেমন অসুবিধা বোধ করেননি। সেই সময় প্রিন্সটনে আইনস্টাইন ছিলেন, এনরিকো ফার্মি ছিলেন। আমার ধারণা আইনস্টাইনকে ম্যানহাটন প্রজেক্টের ডিরেক্টর হওয়ার প্রস্তাব দিলেও তিনি রাজি হতেন না। আমার দৃষ্টিতে আইনস্টাইন ছিলেন একজন কমপ্লিট মানুষ। ওপেনহেইমার জানতেন পারমাণবিক বোমা ব্যবহার হতে পারে। ঘরবষং ইড়যৎ আমেরিকায় গিয়ে এক ফাঁকে ওপেনহেইমারকে বোমা বানাতে নিষেধ করেছিলেন। মজার ব্যাপার হলো ওপেনহেইমারের দুই ছাত্রের একজন ঐবরংবহনবৎম হিটলারের পক্ষে বোমা বানানোর কাজে নিয়োজিত ছিলো আর অন্যজন ওপেনহেইমার আমেরিকার পক্ষে বোমা বানাচ্ছিল। আর ঘরবষং ইড়যৎ দু’জনকেই বোমা বানাতে নিষেধ করেছিলেন। ছবিটি দেখছিলাম আর ভাবছিলাম সেই সময় পদার্থবিজ্ঞানের সৃষ্টিশীল গবেষণার কি অসাধারণ পরিবেশ ছিলো। আমরা এখন পর্যন্ত লেখাপড়া ও গবেষণার মূল্য টের পাইনি। গবেষণাকে পাত্তাই দেই না। আজ পর্যন্ত একটা বিশ্বমানের কাছাকাছি ইনস্টিটিউট তৈরি করতে পারলাম না। অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন ও স্পারসোকে মন্ত্রণালয়ের অধীনে রেখে এই দুটো প্রতিষ্ঠানকে পঙ্গু বানিয়ে রেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অযোগ্য মানুষদের হাতে নেতৃত্ব দিয়ে পঙ্গু বানিয়ে রেখেছি। আবার ওইদিকে দিয়ে উন্নয়ন উন্নয়ন বলে কান ঝালাপালা করে ফেলছে। পৃথিবীর এমন একটি দেশও কি আছে যেই দেশ আগে শিক্ষা ও গবেষণায় উন্নতি না করে উন্নত দেশ হয়েছে? আছে? তো আমরা কি তাহলে ব্যতিক্রম হতে চাই? লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়