রাজনীতির আকাশে কালো মেঘ, অর্থনীতি ঝড়ের মুখে?
কাকন রেজা
চারিদিকের আবহাওয়া পরিষ্কার জানান দিচ্ছে, দেশ এক ভয়াবহ রাজনৈতিক ক্রাইসিসে পড়তে যাচ্ছে। এমনিতেই আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। রিজার্ভ কমার গতি থামেনি। ডলার সংকট নিয়ে বলে আসছি বিগত কয়েকটি লেখাতেই। এলসি খোলা একরকম বন্ধ। মাল খালাস হচ্ছে না। চিনির সংকট কাটাতে চিনি আমদানি করা হয়েছে কিন্তু ডলার সংকটে চিনি খালাস করা যাচ্ছে না। প্রায় দেড়মাস ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে আছে চিনি ভর্তি জাহাজ। এরমধ্যে গণমাধ্যম জানিয়েছে নতুন করে বেড়েছে ডিম, মুরগি, আলুসহ অন্যান্য পণ্যের দাম। অর্থাৎ বিপদ ক্রমশ বাড়ছে। রাজনীতির কালো মেঘ অর্থনীতিতে ঝড়ের আভাস দিচ্ছে।
আগের লেখাতেই বলেছি রাজনীতির সাথে অর্থনীতি সম্পর্কটা নাড়ির। আমাদের এক দায়িত্বশীল যেমন কলকাতায় গিয়ে বলে এসেছেন, ‘কাঁটাতার ভাগ করলেও নাড়ির বন্ধন ছিড়তে পারেনি’। নীতির সঙ্গে রাজ আর অর্থ দুটো আলাদা টার্ম যুক্ত হলেও নাড়ির বন্ধন একই। ভুল রাজনীতির জন্যই অর্থনীতির বারোটা বাজে। এখন যেমন আমাদের প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপটা পুরোপুরি শুরু হলে সেই প্রায় শব্দটাও অদৃশ্য হয়ে যাবে।
রাজনীতির দাবাতে ভুল চাল দেওয়া হলে যা হয়। যাদের সাথে রপ্তানি বাণিজ্য তাদের সাথে বন্ধুত্ব না করে, যাদের সঙ্গে আমদানির সম্পর্ক তাদের সাথে আত্মীয়তা পাতিয়ে ফেলা হয়েছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী পোশাকশিল্প ধুঁকছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ শতাংশ পোশাক রপ্তানি কমেছে। অনেকে হিসেব করে অঙ্ক কষে একে পশ্চিমা দেশগুলোর মূল্যস্ফীতির সাথে যুক্ত করে অর্থনীতিকে রাজনীতি থেকে বিযুক্ত করার অহেতুক চেষ্টা করছেন। তারা ভুলে গেছেন, কথামালা দিয়ে রাজনীতির দৃশ্যমান সংকটকে হয়তো সাময়িক আড়াল করা যায়, সবসময়ের জন্য করা যায় না।
রপ্তানি বাণিজ্য কমে যাওয়ায় ডলার সংকট আরো প্রকট হচ্ছে। আমদানি নির্ভর বাংলাদেশের রপ্তানি আয় মূলত ইউরোপ-অ্যামেরিকার উপর নির্ভর করে। পোশাক থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুরই বড় বাজার ইউরোপ-অ্যামেরিকা। সুতরাং রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স থেকে আয়কৃত ডলার যার প্রায় সিংহভাগই আসে অ্যামেরিকা-ইউরোপ থেকে। অ্যামেরিকা রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়, চতুর্থ বৃটেন। প্রথম হলো সৌদি আরব। কিন্তু এবার অ্যামেরিকা সৌদি আরবকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। সুতরাং রপ্তানি আয় সাথে রেমিট্যান্সের হিসেবেও ইউরোপ-অ্যামেরিকা হলো ডলারের তথা বিদেশী মুদ্রার সর্বোচ্চ জোগানদাতা। বিপরীতে ভারত আর চীনের সাথে বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি তো জানাই। ভারত থেকে আমাদের চাল থেকে পেঁয়াজসহ অনেক কিছুই আমদানি করতে হয়। ভারত আমাদের থেকে তেমন কিছুই নেয় না। চীন থেকে আনি ইলেকট্রনিকস, যন্ত্রাংশসহ নানাকিছু। রাশিয়া থেকে গম, সার। এদের ডলার দিতে হয়। সুতরাং হিসেবের অঙ্কে এদের সাথে আমরা দরকষাকষির পর্যায়ের রয়েছি, কারণ আমরা ক্রেতা। কিন্তু পশ্চিমাদের ক্ষেত্রে আমরা বিক্রেতা। পণ্য ও শ্রম সবই বিক্রি করি আমরা। সুতরাং তাদের সাথে বন্ধুত্বটা প্রয়োজন এবং তা নিজেদের স্বার্থেই। আর নিজের ভালো পাগলেও বোঝে।
খুব অল্প কথা বলার চেষ্টা করলাম অর্থনীতির বিষয়টা। হিসেব খুব যে জটিল তা নয়, শুধু জটিল করে তোলা হয়। আর সেই জটিলতার জন্য দায়ী রাজনীতি। আগেই বলেছি ভুল রাজনীতি অর্থনীতির বারোটা বাজায়। আমাদের বারোটা বাজতে কি খুব বেশি দেরি? প্রশ্নটা কেন করলাম একটু ভেবে দেখুন। এই যে পশ্চিমারা নির্বাচনের কথা বলছে। তাদের কথায় অন্তর্ভূক্তিমূলক, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন। কিন্তু পশ্চিমাদের চাওয়ার বিপরীত ঘটনা ঘটলে কী হবে? হওয়ার মধ্যে হতে পারে নিষেধাজ্ঞা। স¤প্রতি কম্বোডিয়ায় সে স্টাইলে নিষেধাজ্ঞা হয়েছে। কিংবা হতে পারে আরো বড় কিছু। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়লে তো গেলো সব জলে। কিংবা শুধু পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রেই কোটা বা নিষেধাজ্ঞা ধরণের কিছু আসলেই তো কেলো। ঘটিদের ভাষায় সব ঘেটে যাবে। রাজনীতির আকাশে যে কালো মেঘ, তাতে এমন শংকাই মাথায় আসে। সুতরাং শংকা কাটাতে রাজনীতির সঠিক চালটাই রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে কাম্য, তবেই যদি রক্ষা হয়। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট