স্কুলের শিক্ষকেরা কেন এখন রাস্তায় আন্দোলন করছেন?
অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
একটি দেশের স্কুল শিক্ষকেরা একটা মর্যাদাপূর্ণ বেতন স্কেল ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করার দাবিতে বেশকিছু দিন যাবৎ রাস্তায় আন্দোলন করছেন। সরকার তাদের দাবিকে কোনো প্রকার গ্রাহ্য না করে শঠতা ও কপটতার আশ্রয় নিয়েছে। স্কুল ক্যালেন্ডারে গ্রীষ্মের একটা ছুটি আছে, যা ছাত্র শিক্ষকেরা আগে থেকেই জানে এবং সেই অনুযায়ী এই ছুটিকে কীভাবে কাটাবে, তারও একটা পরিকল্পনা থাকতে পারে। সেই ন্যায্য ছুটিকে সরকার আন্দোলন থামানোর হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। আরও মারাত্মক হলো, এই হাতিয়ার ব্যবহারকে জাস্টিফাই করার জন্য নতুন শিক্ষা কারিকুলাম ও পরীক্ষা ইত্যাদিকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করছে। শিক্ষায় যখন এরকম শঠতা ও কপটতা ঢুকায় খোদ মন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়, তখন সেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে? দায়িত্বশীল মানুষ হয়ে এমন শঠতা ও কপটতার আশ্রয় কোনোভাবেই কাম্য নয়। শিক্ষা একটি ডিভাইন বিষয়। এখানে সর্ব ক্ষেত্রে সততা ব্যবহার করতে হবে।
স্কুলের শিক্ষকরা কেন এখন রাস্তায় আন্দোলন করছেন? স্কুলের শিক্ষকেরা স্কুলগুলোকে জাতীয়করণের দাবি জানাচ্ছেন। তারা ১৩তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীতকরণের দাবি জানিয়ে আসছেন অনেকদিন যাবৎ। এমনকি আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালে শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদাসহ ১০ম গ্রেড প্রদানের ঘোষণাও দিয়েছিলেন। কী আশ্চর্য জানেন? প্রধানমন্ত্রীর সেই ঘোষণাও আজ ৯ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি এবং সামনে হওয়ার কোনো লক্ষণও শিক্ষকরা দেখছেন না। সঙ্গত কারণেই শিক্ষকরা ভৎঁংঃৎধঃবফ! এখানে উল্লেখ্য যে অষ্টম শ্রেণিপাস বিএডি গাড়ি চালক বা ড্রাইভারদের বেতন গ্রেড ১২ তম গ্রেডে আর স্নাতক দ্বিতীয় বিভাগ পাওয়া শিক্ষকরা যারা মানুষ গড়ার কাতাদের রাখা হয়েছে ১৩ম গ্রেডে। সত্যি সেলুকাস! বিচিত্র এই বাংলাদেশ। এই দেশে কীভাবে সৎ মেধাবী মানুষ তৈরি হবে?
শিক্ষকরা কম সম্মান এবং কম বেতন পেলে কী ক্ষতিÑ তার জ্বলন্ত উদাহরণ আজ এই বাংলাদেশ। আর শিক্ষকরা ভালো বেতন ও ভালো সম্মান পেলে দেশ কেমন সুখী সমৃদ্ধ হয় তার উদাহরণ নর্ডিক দেশগুলো যেমন নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন প্রভৃতি সভ্য দেশ। শিক্ষকদের কম বেতন দিলে কী ক্ষতি হয় তার বিস্তারিত বলতে গেলে লিস্ট কেবল লম্বাই হবে। কিন্তু বলা শেষ হবে না। শিক্ষকরা বেতন কম পেলে জীবন চালানোর তাগিদেই শ্রেণিকক্ষের বাইরে পড়িয়ে আয় করাকে থামিয়ে রাখতে পারবেন না। ঢাল থাকলে পানিকে যেমন আটকে রাখা যায় না, তেমনি বাধ্য হলে আইন দিয়ে আটকে রাখতে পারবেন না। শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষের বাহিরে পড়ালে এর ক্ষতি অপরিসীম। শিক্ষকরা ক্লাসে কম পড়িয়ে কোচিং বা প্রাইভেট পড়ার ডিমান্ড সৃষ্টি করবে, যা অনৈতিক। এর মাধ্যমে অনৈতিকতা ছাত্রদের মাঝেও ঢুকে যাবে। প্রাইভেট পড়তে গেলে শিক্ষার্থীদের খেলার সময়, সাংস্কৃতিক কাজে অংশগ্রহণ করার মতো সময় অনেক ক্ষেত্রেই অবশিষ্ট থাকে না। বেতন কম পেলে মেরুদÐ থাকে না। আর শিক্ষকদের মেরুদÐ ভাঙা হলে তাদের দিয়ে জাতির মেরুদÐ গঠন অসম্ভব। শিক্ষকেরা তো ঘুষ, দুর্নীতি করে না এবং করার সুযোগও নেই। তারা যেন সহজ সরল সুন্দর জীবন যাপন করতে পারে সেইরকম এমটি বেতন দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। নচেৎ ক্ষতি দেশের। দেশ যে আজ দুর্নীতিবাজ, ধান্দাবাজ, চাপাবাজ ইত্যাদিতে ভরপুর তার কারণও মানসম্পন্ন স্কুলের অভাব, মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব।
সিঙ্গাপুরের রাস্তাঘাট দেখেছেন? জাপানের রাস্তাঘাট দেখেছেন? কেন এতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন? কারণ স্কুলে পড়ার সময়ই শিক্ষকেরা ছাত্রদের মাঝে ঢুকিয়ে দেয় যে যত্রতত্র ময়লা ফেলা যায় না। যেখানে সেখানে কাশি থুথু ফেলা যায় না। কীভাবে রাস্তা পার হতে হয়, প্রাণীদের প্রতি, গাছের প্রতি কীভাবে মায়া দেখাতে হয়। এইগুলোর বীজ ছোটবেলাতেই বপন করতে হয়। এই সুকাজগুলো যারা করবেন তাদেরকে অভুক্ত রেখে, অসম্মান করে কীভাবে পারবেন? শিক্ষকদের একটা আন্দোলন বানচাল করার জন্য ধান্দাবাজি ও শঠতার আশ্রয় না নিলেই কি নয়। দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রী কীভাবে শিক্ষকদের সঙ্গে এমন ছন্দাই নন্দাই করেন? আমাদের দুর্ভাগ্য যে শিক্ষা এবং শিক্ষকবান্ধব সরকার, মন্ত্রী এবং আমলা পেলাম না। শিক্ষকদের বেতন কীভাবে কম দেওয়া যায়, শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা কীভাবে কম দেওয়া যায়Ñ এটাই যেন তাদের সকল কাজের আসল উদ্দেশ্য। যতো সুযোগ-সুবিধা কেবল তাদের জন্যই বাড়তে থাকবে। শিক্ষা তুমি ৎবংঃ রহ ঢ়বধপব!
আপনার সন্তানের কথা ভেবে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে তাদের যৌক্তিক দাবির প্রতি সমর্থন দেওয়া উচিত। সকল স্কুলকে জাতীয়করণ করা যায়। ইউনেস্কোর প্রেসক্রিপশন হলো একটি দেশের জিডিপির ৫.৫ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া উচিত। সেটা দিলে জাতীয়করণের চেয়ে বেশি কিছু করা সম্ভব। দেশ বদলে যেত। এই দেশে চুরি, চামারি, লুটপাট ও পাচার করার জন্য তো টাকার অভাব দেখি না। শিক্ষকদের বেতন ও সুবিধার কথা বললেই এতো শঠতা আর ধূর্ততা কেন? লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়