অ্যাপলের দশটি ব্যর্থ পণ্য
মহসীন আলী রনি
অ্যাপল, বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক টেক জায়ান্ট। ফোর্বসের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ৩.০২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন নিয়ে বিশ্বের বাঘা বাঘা টেক কোম্পানিকে টেক্কা দিয়ে সিংহাসন দখল করে আছে অ্যাপল। শুরু থেকে বহু
চড়াই-উতরাই পার করে প্রথম আমেরিকান কোম্পানি হিসেবে ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে ১ ট্রিলিয়নের ঘর ছুঁতে অ্যাপলের লেগেছে পাক্কা ৪২ বছর। এরপর মাত্র ৪ বছরেই বিশ্বের প্রথম কোম্পানি হিসেবে ৩ ট্রিলিয়নের মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন অর্জন করতে সক্ষম হয় অ্যাপল। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অভাবনীয় এই মাইলফলক অতিক্রম করে কোম্পানিটি। তবে অ্যাপলের ইতিহাস ও যাত্রা যে সবসময় চাকচিক্যময় ছিল, ব্যাপারটা এমনও নয়। অন্যান্য কোম্পানির মতো অ্যাপলকেও গ্রহণ করতে হয়েছে ব্যর্থতার তিক্ত স্বাদ। তাদের অনেক প্রোডাক্টই বাজারে আশানুরূপ মাত্রায় ব্যবসা করতে পারেনি। অ্যাপলের এমন ব্যর্থ দশটি পণ্য নিয়েই আজকের এই আলোচনা।
ঞযব অঢ়ঢ়ষব ওওও : অ্যাপল থ্রি ছিল অ্যাপলের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ব্যর্থ পণ্য। অ্যাপল টু দিয়ে টেকনোলজি জগতে সারা জাগানোর পর এর উত্তরসূরি হিসেবে ১৯৮০ সালের মে মাসে ‘অ্যাপল থ্রি’ কম্পিউটার বাজারে আনে অ্যাপল। কোম্পানির আশা ছিল এটি অ্যাপলের সফলতাকে আরও শীর্ষে নিয়ে যাবে। কিন্তু এর বদলে কম্পিউটার হয়ে যায় অ্যাপলের প্রথম ব্যর্থ প্রোডাক্ট। কম্পিউটারটিতে কোনো ধরনের কুলিং ফ্যান না থাকায় অল্প সময় ব্যবহারেই যন্ত্রটি আগুনের মতো গরম হয়ে যেত। অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়ার ফলে কম্পিউটারের সার্কিট বোর্ডে সমস্যা দেখা দেওয়ার পাশাপাশি সকেট থেকে চিপগুলো খুলে যেত। ফলে যন্ত্রের সম্পূর্ণ সিস্টেমেই সমস্যা লেগে থাকত। এই কারণে অ্যাপল বাধ্য হয়ে বাজারে থাকা প্রায় ১৪ হাজার কম্পিউটার সরিয়ে নেয়। এটাই ছিল অ্যাপলের প্রথম কম্পিউটার, যেটা স্টিভ ওজনিয়াকের ডিজাইন করা নয়।
ঞযব অঢ়ঢ়ষব খরংধ : অ্যাপল লিসার বিশেষত্ব হলো, এই কম্পিউটারে একটি গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেস যুক্ত ছিল। এখন সবার হাতে হাতে ল্যাপটপ পাওয়া গেলেও ১৯৮০ এর দশকে গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেস সংবলিত একটি পার্সোনাল কম্পিউটার থাকা ছিল মোটামুটি দুর্লভ এক জিনিস। কারণ কম্পিউটার তখনও আজকের দিনের মতো এত সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। এজন্য পকেট থেকে প্রায় ১০ হাজার ডলার খরচ করে নিজের প্রথম গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেসসহ পার্সোনাল কম্পিউটার হিসেবে অ্যাপল লিসা কিনতে দ্বিধা করেনি মানুষ। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেসের এই ফিচার বাদে কম্পিউটারটির এত চড়া দাম কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। এছাড়াও ডিভাইজটি ছিল অনেক ধীরগতির। ব্যবহার করাও বেশ কঠিন হওয়ায় ব্যবহারকারীদের বেশ হতাশ হতে হতো। ফলে ১৯৮৬ সালে অ্যাপল এমন এক সুযোগ দেয়, যেখানে বলা ছিল, অ্যাপল লিসার ব্যবহারকারীরা তাদের কম্পিউটারের বিনিময়ে ৪১০০ ডলারের ম্যাক প্লাস মাত্র ১৫০০ ডলারে কিনতে পারবে। অনেকেই সেই সুযোগ লুফে নেয়। কম্পিউটার প্রতি ৯,৯৯৫ ডলারে তারা প্রায় ১০ হাজার লিসা কম্পিউটার বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছিল। এই ১০ হাজার কম্পিউটার বানাতে তাদের খরচ হয়েছিল ১৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যেখানে এগুলো থেকে প্রাপ্ত আয়ের পরিমাণ ছিল ১০০ মিলিয়ন ডলার।
অঢ়ঢ়ষব গধপরহঃড়ংয চড়ৎঃধনষব : এটি ছিল অ্যাপলের সর্বপ্রথম ব্যাটারিচালিত ল্যাপটপ। ম্যাকিন্টোশ পোর্টেবল কম্পিউটারটি নামে পোর্টেবল হলেও এটা উত্তোলন করা মোটেও সহজ ছিল না। কারণ, এর ওজন ছিল ৭ কেজির কাছাকাছি। ব্যাটারির জটিলতার কারণে প্লাগ-ইন করার পরেও কম্পিউটারটি মাঝেমধ্যে চালু হতো না। ১৯৮৯ সালে বাজারে আনার পর মাত্র দুই বছর বাজারে স্থায়ী ছিল ডিভাইসটি। তৎকালীন ৭,৩০০ মার্কিন ডলারের এই কম্পিউটারে ছিল ১ মেগাবাইট র্যাম এবং ২৫৬ কিলোবাইট রম। পোর্টেবলের নামে ডিভাইসটি একপ্রকার ডিজাস্টার ছিল।
ঈড়ঢ়ষধহফ : কপল্যান্ড ছিল অ্যাপলের অন্যতম উচ্চাভিলাষী এক প্রজেক্ট। ১৯৯০ এর দশকে ম্যাকিন্টোশ সিস্টেম যুগের সাথে তাল মেলাতে না পারায় অ্যাপল কপল্যান্ড নামে নতুন একটি মডেল সিস্টেম বাজারে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করে। কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, কপল্যান্ডের অপারেটিং সিস্টেমটি উইন্ডোজের বিভিন্ন অ্যাপ রান করার পাশাপাশি এটি মাইক্রোসফট উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের সাথে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতায় নামবে। কিন্তু কয়েকবছর ধরে টানা চেষ্টার পরেও অ্যাপল কোনো আশানুরূপ ফলাফল দেখাতে পারেনি বলে প্রজেক্টটি বাতিল করে দিতে হয়।
ঞযব অঢ়ঢ়ষব চরঢ়ঢ়রহ : কন্সোল গেমিং মার্কেটে পিপিন দিয়ে বাজিতে হারে অ্যাপল কোম্পানি। গেমিং জগতে আগে থেকেই সনি, নিন্টেন্ডো এবং সেগার মতো কোম্পানিগুলো সগৌরবে তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছিল। ফলে জনপ্রিয় গেম নির্মাতা কোম্পানিগুলোও এই ডিভাইসগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখেই গেম তৈরি করত। ১৯৯৬ সালে প্রতিযোগিতার বাজারে আসা এই অ্যাপল পিপিনের দাম ছিল ৬০০ ডলার। অপরদিকে পকেট থেকে মাত্র ২০০ ডলার খরচ করলেই হাই পারফরম্যান্সের নিন্টেন্ডো ৬৪ কন্সোল পাওয়া যেত। উচ্চ দামের কারণেই বাজারে এক বছরের বেশি স্থায়ী হতে পারেনি অ্যাপল পিপিন। এছাড়াও এতে গেমের সংখ্যা ছিল তুলনামূলক অল্প। প্রথম বছরে ৩ লক্ষ ইউনিট বিক্রির লক্ষ্য থাকলেও থাকলেও বছর শেষে ১২-৪২ হাজারের মতো ডিভাইস বিক্রি করতে সক্ষম হয় অ্যাপল।
ঞযব ঘবঃিড়হ : বিজ্ঞানী নিউটন আর আপেল যেন একই সূত্রে গাথা। সেই কাহিনির সাথে মিল রেখেই অ্যাপল তাদের কোম্পানির প্রোডাক্ট দ্য অ্যাপল নিউটন দিয়ে বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিল। ১৯৮৭ সালে তারা অ্যাপল নিউটন ডিভাইসের মাধ্যমে পিডিএ মার্কেটে প্রবেশ করতে চেয়েছিল। এই যন্ত্রের বিশেষ ফিচার ছিল হাতের লেখাকে টেক্সটে পরিণত করা। কিন্তু ডিভাইসটির পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক। তাই একে অ্যাপলের অন্যতম ব্যর্থ পণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়।
অঢ়ঢ়ষব বগধঃব : অ্যাপল ইমেইট মূলত পামটপ ও ল্যাপটপের সংমিশ্রণে তৈরি এক হাইব্রিড ডিভাইস। এটিই অ্যাপলের একমাত্র নিউটন ডিভাইস যাতে কি-বোর্ড বিল্ট ইন ছিল। নিউটনের অপারেটিং সিস্টেমও দেওয়া হয়েছিল এতে। দাম ছিল সাধ্যের মধ্যে, ৭৯৯ ডলার। এর ডিজাইনই ছিল বর্তমানের আইম্যাক ও আইবুকের অনুপ্রেরণা। সমস্যা ছিল, এটা শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছেই বিক্রি করা হতো। তাই মুক্তির মাত্র ১১ মাস পরেই প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে যায় ইমেইট।
২০ঃয অহহরাবৎংধৎু গধপরহঃড়ংয : অ্যাপল কোম্পানির ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কোম্পানিটি ম্যাকিন্টোশ কম্পিউটারের এক বিশেষ সংস্করণ বের করে ব্যবহারকারীদের চমক দিতে চেয়েছিল। এলসিডি ডিসপ্লে, এফএম রেডিও, টিভি টিউনার, সিডি-রম ড্রাইভ, বোস সাউন্ড সিস্টেম- কী ছিল না এর ভেতরে? ‘একের ভিতর সব’ ফিচারের যুতসই উদাহরণ ছিল এই ‘২০ঃয অহহরাবৎংধৎু গধপরহঃড়ংয‘। এতসব ফিচার এক কম্পিউটারে যুক্ত করার ফলে এর দাম দাম হয়ে উঠেছিল তুলনামূলক অধিক। উচ্চ দামের কারণেই এই পণ্যটি ব্যর্থ হয়। ১৯৯৭ সালে বাজারে আসার সময় এর দাম ছিল ৭,৫০০ ডলার। মাত্র ১২ হাজার ইউনিট পণ্য বানালেও তারা ওই দামে তা তেমন বিক্রি করতে পারেনি। পরবর্তীতে, দাম ৭৫% কমিয়ে ২,০০০ ডলারে বিক্রির মাধ্যমে স্টক শেষ করা হয়। এ৪ ঈঁনব : দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন দিয়ে ২০০১ সালে জি৪ কিউবকে বাজারে ছেড়েছিল অ্যাপল। কিন্তু বাজারে নিজের জায়গা বেশিদিন স্থায়ী রাখতে পারেনি পণ্যটি। এর নির্ধারিত দাম ১,৭৯৯ ডলার হলেও এর সাথে কোনো মনিটর দেওয়া হতো না। যেখানে মাত্র ২০০ ডলারেই অ্যাপলের পাওয়ার ম্যাক জি৪ কম্পিউটারটি পাওয়া যেত, সেখানে এত বেশি দাম দিয়ে এই পণ্য কেনা অপচয় ছাড়া কিছুই না। তাই মাত্র ১ বছর পরেই মার্কেট থেকে হারিয়ে যায় জিফোর কিউব। অরৎচড়বিৎ ডরৎবষবংং ঈযধৎমবৎ: ২০১৭ সালে অ্যাপল একটি এয়ারপাওয়ার ম্যাট আনার ঘোষণা দেয় যা একইসাথে আইফোন, এয়ারপড এবং আই ওয়াচ চার্জ করতে পারবে। এমনকি সবকিছু ভালোমতো চার্জ হচ্ছে কি না, তা-ও সময়মত জানান দেবে ম্যাটটি। কিন্তু ২০১৮ সালে নির্দিষ্ট তারিখ বাজারে ছাড়তে না পারায় এই প্রজেক্ট বাতিল করে দেয় অ্যাপল। সূত্র : রোর বাংলা