একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের জন্য ‘শিক্ষা দান তহবিল’র গুরুত্ব
ড. ফয়সাল খান
বাংলাদেশে শিক্ষার প্রসারের জন্য শিক্ষা দান তহবিল (এন্ডাউমেন্ট ফান্ড) এবং ওয়াকফ হিসেবে জমি দান করার একটি সমৃদ্ধ ও শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে। এমনকি আমাদের কাছে মুষ্টির চালের ধারণা ছিল (প্রতিদিনের রান্নার আগে চালের একটি অংশ আলাদা করে রাখা), যা সামাজিক উদ্দেশ্যে যেমন অভাবীকে খাওয়ানো, স্কুল, লাইব্রেরি, স্বাস্থ্যসেবা এবং রাস্তা নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হত। স¤প্রতি শিল্প-একাডেমিয়া সংযোগ বিষয়ক এক সেমিনারে মাননীয় প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এই ঐতিহ্য হারানোর জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। তিনি আরও বলেন এখন উন্নয়নমূলক কাজে জনগণের অংশগ্রহণ দিন দিন কমে যাচ্ছে কারণ এগুলো মূলত সরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলো করে থাকে।
বাংলাদেশে মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার ব্যাপক চাহিদা মেটাতে সরকারি ও এনজিও তহবিল পর্যাপ্ত নয়। এই প্রেক্ষাপটে তিনি জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ তৈরি করার জন্য গবেষণা এবং উদ্ভাবনের সংস্কৃতিকে উন্নত করার জন্য শিক্ষা দান তহবিলের (এন্ডাউমেন্ট ফান্ডের) পুনরুজ্জীবনের উপর জোর দেন। তাহলে একটি শিক্ষা দান তহবিল (এনডাউমেন্ট ফান্ড) কী এবং এটি কীভাবে একটি জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়তা করতে পারে? একটি শিক্ষা দান তহবিল (এনডাউমেন্ট ফান্ড) হল একজন দাতা বা দাতাদের একটি দল কর্তৃক প্রিন্সিপাল হিসাবে প্রদত্ত অর্থের সমষ্টি, যা চিরস্থায়ী তহবিলে রাখা হয় এবং একজন ট্রাস্টি দ্বারা পরিচালিত হয়। তারপর মূল অর্থ বিনিয়োগ করা হয় একটি লাভজনক রিটার্ন পাওয়ার জন্য এবং সেই রিটার্নটি শিক্ষা দান তহবিলে(এনডাউমেন্ট ফান্ডে) মনোনীত নির্দিষ্ট ক্ষেত্র এবং উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। যেহেতু একটি শিক্ষা দান তহবিল (এনডাউমেন্ট ফান্ড) চিরস্থায়ী প্রকৃতির, তাই এটি স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য সুবিধা তৈরি করতে টেকসই এবং দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত। আজকের বিশে এনডাউমেন্ট ফান্ড ধারণাটি সবচেয়ে বড় আর্থিক সম্পদের একটি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য সমর্থনের একটি চিরন্তন উৎস। উদাহরণস্বরূপ হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ১৪,০০০ টিরও বেশি স্বতন্ত্র তহবিল রয়েছে যা একক সত্তা হিসাবে বিনিয়োগ করা হয় এবং এনডাউমেন্টের রিটার্নগুলো বিভিন্ন প্রোগ্রাম, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং বিভিন্ন একাডেমিক ক্ষেত্রের অধ্যাপকদের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য ব্যবহৃত হয়।
শিক্ষা দান তহবিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আয়ের অস্থিরতা এড়াতে এবং মসৃণভাবে চলতে সাহায্য করতে পারে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ করার জন্য সরকারের সংস্থান নেই। ইউনেস্কো শিক্ষা খাতে জিডিপির চার থেকে ছয় শতাংশ ব্যয় নির্ধারণ করে। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে এই পরিমাণ ছিল ঋণ২০২৩-এ মাত্র ১.৮৩ শতাংশ এবং ঋণ২০২৪-এ তা ১.৭৬ শতাংশের কম। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারী তহবিল, দাতা এবং টিউশন ফি এর উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। যদিও বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সরকারী সহায়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবুও উন্নত বিশ্বের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণত যে সকল প্রোগ্রাম অফার করে সেগুলোকে সহজতর করার জন্য আমাদের এখনও তহবিলের অভাব রয়েছে।
এই প্রসঙ্গে একটি এনডাউমেন্ট ফান্ড গঠনে বাংলাদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে এনডাউমেন্ট ফান্ডের জন্য কোনো আইনি কাঠামো নেই। নিশ্চিততা তৈরি করতে এবং অনেক স্টেকহোল্ডার এবং শেয়ারহোল্ডারদের শিক্ষা এনডাউমেন্টের যাত্রা শুরু করতে উৎসাহিত করার জন্য এটি প্রয়োজনীয় হবে। আমরা যদি আইন প্রণয়নের স্বচ্ছতা ও সুষ্ঠতা বজায় রাখতে পারি, তাহলে এটি ধনী অনাবাসী বাংলাদেশি এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষা সংস্থাগুলোকে বাংলাদেশে শিক্ষা এনডাউমেন্ট ফান্ড প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করবে। আমরা দেখছি যে অনেক কর্পোরেট এবং সংস্থা যারা কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) অধীনে শিক্ষা খাতে সহায়তা করতে চায় তারা শিক্ষা এনডাউমেন্ট ফান্ডের ধারণা সম্পর্কে সচেতন নয়।
এটি সংশোধনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো উচিত। এই সমস্যাটি কাটিয়ে উঠতে শিল্প এবং একাডেমিয়ার মধ্যে একটি সেতু তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প একটি নির্দিষ্ট ট্যালেন্ট পুল তৈরি করার জন্য একটি একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে একটি এন্ডাউমেন্ট ফান্ড প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যার সদস্যরা তখন শিল্পের অধীনে কর্মশক্তিতে যোগ দিতে পারে। আমরা আরও দেখি যে প্রাক্তন ছাত্র এবং একাডেমিয়ার মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। যোগাযোগের অভাবের কারণে প্রাক্তন ছাত্ররা তাদের স্নাতক শেষ করার পরে শিক্ষা এনডাউমেন্ট ফান্ডে দান করার জন্য কোন সিরিয়াস আগ্রহ দেখায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের প্রাক্তন ছাত্রদের নেটওয়ার্কগুলোকে পুঁজি করে শিক্ষা বৃত্তি স¤প্রসারণে সক্রিয় হতে হবে। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রদানকারীদের তাদের প্রাক্তন ছাত্রদের একটি আপডেট ডেটাবেজ বজায় রাখতে হবে যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এনডাউমেন্ট শিক্ষা তহবিলে অবদানের জন্য তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়।
গত তিন দশকে বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষায় ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। ইতিমধ্যে দেশের অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২৬ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করতে প্রস্তুত। এখন আমাদের একটি বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যা আমাদের উৎপাদন-ভিত্তিক অর্থনীতিকে জ্ঞান-ভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তর করতে সাহায্য করবে, তাই ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা উন্নত দেশের মর্যাদাও অর্জন করতে পারব। যেহেতু উচ্চশিক্ষার জন্য শুধুমাত্র সরকারি খরচই মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট নয়, তাই শিক্ষা এনডাউমেন্ট ফান্ড বাংলাদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক অবস্থাকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করতে পারে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এন্ডাউমেন্ট তহবিল বাড়াতে গণসচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়ার এখনই সময়। প্রাথমিক পর্যায়ে আইনি কাঠামোর অভাব এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতার কারণে এন্ডাউমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা বাংলাদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে। যাইহোক যদি এই প্রতিষ্ঠানগুলো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে এবং আন্তর্জাতিক সেরা অনুশীলন থেকে শিক্ষা নিতে প্রস্তুত থাকে, তাহলে এনডাউমেন্ট ফান্ড বাংলাদেশে শিক্ষা অর্থায়নে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে।
ড. ফয়সাল খান, একজন স্বাধীন গবেষক এবং আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়া থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি করেছেন। সূত্র : ডেইলি স্টার। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ