
কতোটা গরম মানুষের শরীরের জন্য সহনশীল?

কামরুল হায়দার
এই বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে, আকাশ ছোঁয়া তাপমাত্রা ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক জায়গায় রেকর্ড ভেঙেছে। এইভাবে যখন ২০২৩ সালের গ্রীষ্মকাল শেষ হবে, এটি সম্ভবত মানব ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণতার রেকর্ড হবে, তবে এটি আবারও সবচেয়ে শীতলতার রেকর্ডও হতে পারে বছর শেষে। ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালিতে নজিরবিহীন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে, যেখানে জুলাইয়ের তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই ৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। ডেথভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের সদর দফতর ফার্নেস ক্রিক-এ ১০ জুলাই ১৯১৩-এ এই উপত্যকায় উষ্ণতম বায়ুর তাপমাত্রা ৫৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস-এর বিশ্ব রেকর্ড রয়েছে। প্রচÐ গরমের মধ্যেও পর্যটকরা এই চরম আবহাওয়া অনুভব করতে দলে দলে ডেথ ভ্যালিতে ছুটে আসছে এবং এপর্যন্ত পার্কে শুধুমাত্র ৭১-বছর-বয়সী এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে ১৮ জুলাই তাপমাত্রা ৪৯.৪ ডিগ্রী পৌঁছানোর সাথে সাথে তিনি পড়ে যান এবং মারা যান।
বিশ্বের অন্য প্রান্তে ভারতের দুটি সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশ এবং বিহার জুড়ে প্রবল তাপপ্রবাহের কারণে তাপ-সম্পর্কিত অসুস্থতায় জুন মাসে কয়েক দিনের মধ্যে প্রায় ১০০ জনেরও বেশি লোক মারা গেছে বলে জানা গেছে। তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বেড়ে যাওয়ার সময় এই মৃত্যু ঘটে। ডেথ ভ্যালিতে মাত্র একজনের মৃত্যু সত্তে¡ও, ভারতে কেন এত মানুষ মারা গেল যেখানে উপত্যকার তাপমাত্রা তার চেয়ে আট ডিগ্রি কম ছিল? আমাদের শরীর কতটা তাপ নিতে পারে এবং বেঁচে থাকতে পারে তা কী নির্ধারণ করা যায় ? উত্তরটি ওয়েট-বাল্ব তাপমাত্রায় (ডবিøউবিটি) যা পরিবেষ্টিত বায়ু তাপমাত্রার মতো নয়। জলে ভেজানো কাপড়ে মোড়ানো থার্মোমিটার দ্বারা পরিমাপ করা হয়, ডবিøউবিটি তাপ এবং আর্দ্রতা উভয়কেই বিবেচনা করে। এটি সর্বনি¤œ তাপমাত্রা যেখানে একটি বস্তু শীতল হতে পারে যখন এটি থেকে আর্দ্রতা বাষ্পীভ‚ত হয়। ২০২০ সালে সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, মানুষের জন্য, ডবিøউবিটি ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আমরা ৩৭ ডিগ্রি শরীরের তাপমাত্রায় ঘামকে জলীয় বাষ্পে রূপান্তর করে নিজেদেরকে শীতল করি। এই তাপমাত্রা তাপ হ্রাস এবং তাপ বৃদ্ধির মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে বায়ু উষ্ণ হয়ে উঠবে এবং তাই আরও আর্দ্রতা ধরে রাখতে সক্ষম হবে। এর ফলে আর্দ্রতা বৃদ্ধি পাবে এবং ওয়েট-বাল্ব তাপমাত্রা (ডবিøউবিটি) বৃদ্ধি পাবে। তাপমাত্রা খুব উচ্চ হবে সপ্তাহ এবং মাস ধরে চলবে, যেমনটি আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি ব্যাপক এলাকা জুড়ে। ফলস্বরূপ গ্রীষ্মের মাঝারি তাপমাত্রার মধ্যেও তাপজনিত মৃত্যু বৃদ্ধি পাবে। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকলে ডবিøউবিটি বেশি হবে। একটি উচ্চ ডবিøউবিটি আমাদের শরীরের ঘাম বের হতে বাধা দেবে এবং এর মূল তাপমাত্রা বজায় রাখতে নিজেকে ঠান্ডা করবে। ফলস্বরূপ শরীর অতিরিক্ত গরম হবে, রক্ত আমাদের ত্বকে তাপ মুক্ত করার চেষ্টা করতে বাধ্য করবে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলির ক্ষতি হবে। শরীর হাইপোথার্মিক হয়ে যাবে (হাইপোথার্মিয়া থেকে আলাদা, যা ঘটে যখন আমাদের শরীরের তাপমাত্রা বিপজ্জনকভাবে নি¤œ স্তরে নেমে যায়), যার ফলে বমি বমি ভাব, দুর্বলতা, মাথা ঘোরা এবং পানিশূন্যতা, দ্রæত স্পন্দন, মানসিক অবস্থার পরিবর্তন, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, কোমা এবং অবশেষে মৃত্যু। যদি আর্দ্রতা কম হয় কিন্তু তাপমাত্রা বেশি হয় বা বিপরীতভাবে ডবিøউবিটি সম্ভবত আমাদের শরীরের টিপিংপয়েন্টের কাছাকাছি থাকবে না।
উদাহরণস্বরূপ যদি তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি এবং আর্দ্রতা ২০ শতাংশ হয়, ডবিøউবিটি হয় মাত্র ৩২ ডিগ্রি, যেখানে আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রা উভয়ই খুব বেশি হয়, ডবিøউবিটি বিপজ্জনক স্তরের দিকে যেতে পারে। একবার ডবিøউবিটি ৩৫ ডিগ্রী অতিক্রম করে, এ সময়ে টিকে থাকা কঠিন হবে। যারা বাইরে কাজ করে এবং যাদের অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য এটি বিশেষভাবে সত্য। যদিও উচ্চ ডবিøউবিটিতে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে, নি¤œ তাপমাত্রাও মারাত্মক হতে পারে। গবেষণায় দেখা যায় যে আমাদের শরীরের তাপমাত্রার নি¤œ সীমা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর নীচে শরীর তার মূল তাপমাত্রা বজায় রাখতে আরও শক্তি ব্যয় করে। এটি করার একটি উপায় হল কাঁপুনি, যখন আমাদের পেশীগুলি অনিচ্ছাকৃতভাবে তাপ উৎপাদন করতে সংকুচিত হয়। তাপমাত্রার নি¤œ পরিসীমা প্রতিষ্ঠিত হলেও, উপরের সীমা এখনও অনিশ্চিত।
জুন মাসে উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে তাপপ্রবাহের সময় আর্দ্রতা ছিল ৫৩ শতাংশ, যার ফলে ডবিøউবিটি ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়, যা তাপ এবং আর্দ্রতার সাথে মানুষের অভিযোজন ক্ষমতার উপরের সীমার চেয়ে বেশি। অন্যদিকে ডেথ ভ্যালিতে গড় আর্দ্রতা প্রায় ১৫ শতাংশ। অতএব যখন তাপমাত্রা ৫৩ ডিগ্রি হয়, তখন ডবিøউবিটি সহনীয় মাত্রা ২৯ ডিগ্রি। তাই মৃতের সংখ্যায় বড় পার্থক্য দেখা যায়। ঢাকার হিসাবে জুলাই মাসে গড় তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ৭৫ শতাংশ আর্দ্রতা, ডবিøউবিটি ২৯.২ ডিগ্রি। যেহেতু ডবিøউবিটি মানুষের প্রচুর ঘামের জন্য যথেষ্ট কম, তাই ঢাকায় খুব কমই তাপজনিত মৃত্যু হয়। তবে এর মানে এই নয় যে তাপপ্রবাহের সময় জীবন আরামদায়ক হবে। মানুষ আশ্চর্যজনকভাবে সহনশীল প্রাণী, তবে তাদের সহনশীলতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার মাধ্যমে ভয়ানক ঘূর্ণিঝড় থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি।
বিধ্বংসী বন্যা বা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে প্লাবিত এলাকায় আমরা উঁচু বাড়ি – মাচা তৈরি করতে পারি। কিন্তু একটি তাপদাহ বা তাপপ্রবাহ হলো ভিন্ন এটার সাথে খাপ খাওয়াতে ধনীরা তাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়িতে এবং অফিসে আরামে নিজেকে ঠান্ডা রাখতে পারে বা শীতল কোনো জায়গায় দীর্ঘ ছুটিতে যেতে পারে, গৃহহীন এবং দরিদ্র লোকেদের জন্য বিশেষ করে যাদের বাইরে কাজ করতে হয় তাদের জন্য গরম তাপমাত্রার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয় এবং তাদের এয়ার কন্ডিশনার বা ফ্যানের বিলাসিতা নেই যা ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেয়ে আলাদা। নাসার মতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পারস্য উপসাগর এবং লোহিত সাগর, পূর্ব চীন এবং ব্রাজিল সহ অনেক অঞ্চলে ডবিøউবিটি ২০৫০ সালের মধ্যে সর্বোত্তম মান ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। তাই যদি আমরা সত্যিই বাঁচতে চাই এই অতিরিক্ত তাপপ্রবাহ থেকে নিজেদেরকে বাঁচানোর সবচেয়ে সহজ এবং বিশুদ্ধ উপায় হল আমাদের সরকারকে আর দেরি না করে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো বন্ধ করতে বাধ্য করা।
ডা. কামরুল হায়দার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ফোর্ডহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞা
