মুদ্রাস্ফীতি, প্রাক-নির্বাচন এবং ডেঙ্গুর ভয়াবহ পরিস্থিতি
আনু মুহাম্মদ
বাংলাদেশের মানুষ বর্তমানে নানা সংকটের সম্মুখীন। একদিকে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, তা কমাতে কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপ নেই। এ বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রীর ভিন্ন ভিন্ন কথা রয়েছে। একজন বলছেন, দেশের মানুষ ভালো আছেন, আরেকজন বলছেন, সিন্ডিকেটের সঙ্গে হস্তক্ষেপ করার উপায় নেই। তবুও অন্যরা ইঙ্গিত করছে যে পরিস্থিতি অনিবার্য। এই সবের মানে হলো যে জনগণ শীঘ্রই তাদের আর্থিক দুর্ভোগের শেষ দেখতে পাবে না যেকোনো সময়। এখন দ্রব্যমূল্য যখন এভাবে বাড়বে তার মানে কী? এটি মানুষের প্রকৃত আয় হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু প্রকৃত আয় ছিল বেশ কম। যেমন গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন ধরা যাক, যাদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ছিল ৮,০০০ টাকা। যদি গত কয়েক বছরের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য করা হয়, তবে সেই টাকার প্রকৃত মূল্য এখন প্রায় ৫,০০০ টাকা। সুতরাং একজন ন্যূনতম মজুরিপ্রাপ্ত গার্মেন্টস শ্রমিকের আগের মতো ক্রয় ক্ষমতা রাখতে হলে তাদের ১১,০০০ টাকা বা তার বেশি বেতন দিতে হবে।
মুদ্রাস্ফীতি মোকাবেলায় সরকারি কর্মীদের বেতন পাঁচ শতাংশ বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে সরকার। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ এই বেতন বৃদ্ধির আওতায় পড়ে না। দ্বিতীয় সংকট দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ যথা প্রচÐ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আগ্রাসন আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এটা কতদূর যাবে কেউ জানে না। ইইউ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়ার মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের বিভিন্ন অবস্থানের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ বাংলাদেশে একটি সত্যিকারের নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দিক থেকে চাপ দিচ্ছে। কতো দুঃখজনক যে আমাদের স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও, এই দেশের জনগণের চেয়ে বিদেশি দেশগুলো আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলে! আরও দুঃখের বিষয় হলো যে আমাদের নিজস্ব আইন প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ যদি সঠিকভাবে কাজ করতো। তবে এর কোনোটিরই প্রয়োজন হতো না। নির্বাচন কমিশন যদি নাগরিকদের ন্যূনতম ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সক্ষম হতো, তাহলে এই অন্যান্য দেশগুলো হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন অনুভব করতো না।
অভ্যন্তরীণ প্রতিবাদের চেয়ে বাহ্যিক চাপের ফল বেশি হওয়ার এটাই একমাত্র উদাহরণ নয়। বাংলাদেশের জনগণ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাÐ বন্ধ করতে এবং জনগণকে হয়রানি করতে এবং বাকস্বাধীনতাকে দমন করার জন্য ব্যবহৃত কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের জন্য বিভিন্ন বিক্ষোভ করেছে। কিন্তু সরকারের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়েনি। তবুও যখন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল, তখন আমরা নৃশংসতার সংখ্যা হ্রাস হতে দেখতে পেয়েছি। বাইরের চাপ ফলাফলের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় জনগণের চাওয়া কমিয়ে দেওয়ার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে?
ডেঙ্গু পরিস্থিতি, ঢাকার অবস্থা ভয়াবহ এবং দ্রæত দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গু মহামারীকে সতর্কতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে এবং এটি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার এবং বিশেষত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরর কাছ থেকে যে ধরনের জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল তা এখনও অনুপস্থিত, যখন সংক্রমণ এবং মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। সিটি কর্পোরেশনগুলোর জন্য সাধারণ জ্ঞানের মতো মনে হচ্ছে হটস্পটগুলোর কাছাকাছি যেমন নির্মাণ সাইট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস এবং আবর্জনার স্ত‚পের সঙ্গে যেকোনও জায়গায় মশা এবং তাদের লার্ভাগুলো পরিষ্কার করার জন্য আরও বেশি লোক নিয়োগ করা। তবুও এই প্রচেষ্টা অনুপস্থিত, ব্যর্থতার একটি প্রধান উদাহরণ হলো জুরাইন এলাকা। তথাকথিত উন্নয়ন কর্মকাÐের কারণে এলাকায় সবসময় গর্ত ও জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে। এমনকি যখন ডেঙ্গু কোনো সমস্যা ছিল না, তখনও জুরাইনের বাসিন্দারা আরও অনেক রোগের সংস্পর্শে এসেছিলেন। সিটি কর্পোরেশন এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থা তাদের কাজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় এটি ঘটেছে।
ডেঙ্গু রোগীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যাকে মিটমাট করার জন্য প্রায় পর্যাপ্ত শয্যা না থাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও সক্রিয় হওয়া উচিত ছিল। নি¤œ আয়ের মানুষ যারা আগে থেকেই মূল্যস্ফীতির কারণে ভুগছিল তারা ডেঙ্গুর অনিয়ন্ত্রিত বিস্তারের কারণে এখন আরও খারাপ অবস্থায় আছে। সেই হিসেবে এতোক্ষণে রোগের পরীক্ষা ও চিকিৎসা সবার জন্য বিনামূল্যে করা উচিত ছিল। সুতরাং বাংলাদেশের জনগণ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে তাদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার অধিকার নিয়ে অনিশ্চিত এবং মন্দার দিকে অগ্রসর হওয়ায় অর্থনীতিতে তারা একটি অনিরাপদ আর্থিক অবস্থায় রয়েছে। তদুপরি বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতির মতো স্বাস্থ্য সংকটের বিরুদ্ধে ন্যূনতম প্রতিরক্ষা না থাকায় এবং এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরকারি প্রচেষ্টার অভাবের ঝুঁকিতে রয়েছে জনগণ। অবশ্যই পরিস্থিতি সবার জন্য এক নয়। কিছু গোষ্ঠী, যাদের অর্থনৈতিক পরিভাষায় অলিগোপলি বলা যেতে পারে, তারা বিদ্যুত খাত থেকে প্রচুর আয় পায়, তাদের সুবিধার জন্য তৈরি করা চুক্তির কারণে।
গত ১৪ বছরে কোনো বিদ্যুৎ সরবরাহ ছাড়াই এসব বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকারের কাছ থেকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা পেয়েছে। ক্রমাগত লুটপাট হওয়া সত্তে¡ও এবং সামগ্রিক ব্যাংকিং খাত দুর্বল হওয়া সত্তে¡ও ব্যাংকগুলোও আরও বেশি সমর্থন পাচ্ছে। ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতনের কারণে গার্মেন্টস মালিকরাও বিপুল মুনাফা পাচ্ছে। এদিকে শ্রমিক শ্রেণীর প্রকৃত আয় ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। এই সবকিছু শীঘ্রই পরিবর্তন করা প্রয়োজন এবং পরিবর্তন আসতে হবে ভেতর থেকে। অনেকেই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। কিন্তু এটা আমাদের মনে রাখা ভালো হবে যে আমরা যদি অন্য দেশের ওপর নির্ভর না করি তাহলে প্রগতিশীল পরিবর্তন ঘটবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা রাশিয়া যাই হোক না কেন, তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব এজেন্ডা এবং স্বার্থ রয়েছে যে তারা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে। এ কারণেই যতোক্ষণ না আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ তাদের রাজনৈতিক অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার এবং একজন মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার সঙ্গে জড়িত ন্যূনতম অধিকার দাবি ও রক্ষায় নিয়োজিত না হয়, ততোক্ষণ এই অনিশ্চয়তা, দুর্ভোগ এবং শোষণের মধ্যেই চলবে।
আনু মুহাম্মদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। সূত্র : ডেইলি স্টার। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ