কর্তৃপক্ষের আগ্রহ ও যথাযথ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হলে দেশে আগামী মৌসুমের আগেই ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন পাওয়া সম্ভব : ডা. লেলিন চৌধুরী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
ভূঁইয়া আশিক রহমান
[১] বাংলাদেশে এডিস মশা নির্মূল করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা কতোটা সম্ভব?
ডা. লেলিন চৌধুরী : ২০১৯ সালের আগে ডেঙ্গু ছিলো একটি শহুরে সংক্রামক রোগ। কিন্তু ২০১৯ সালের যে মহামারি হয়েছিলো তার মধ্যদিয়ে ডেঙ্গু সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গু এখন কেবলমাত্র বর্ষা মৌসুমের রোগ নয়, সারাবছর ধরে ডেঙ্গুর কমবেশি সংক্রমণ চলমান থাকে। ইতোমধ্যে এডিস মশার আবাসিক বা গৃহপালিত ধরনের (এডিস ইজিপ্টি) সঙ্গে বন্য বা জঙ্গলে বসবাসকারী ধরন (এডিস অ্যালবোপিকটাস) ডেঙ্গুর বাহকে রূপান্তরিত হয়েছে। যদিও ২০১৯ সালের আগে শুধু গৃহপালিত এডিস মশা দ্বারা ডেঙ্গু ছড়াতো। বাংলাদেশ একটি জনবহুল এবং পরিকল্পনাহীন গৃহায়নের দেশ। নগর-মহানগরগুলো গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। এমতাবস্থায় সারা দেশের এডিস মশার দুটো ধরনকে নির্মূল করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ একটি অতি কঠিন কাজ। এর জন্য যে পরিমাণ প্রাপ্তবয়স্ক মশা ও মশার শুককীট মারার ওষুধ, প্রশিক্ষিত জনবল দরকার তা জোগাড় করা আমাদের জন্য আয়াসসাধ্য। করোনা মহামারি প্রতিরোধে গণটিকা দেওয়ার একটি বিপুল ইতিবাচক অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। তাই সর্বরকম বিবেচনায় আমাদের জন্য উত্তম উপায় হচ্ছে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন প্রদান করা।
[২] ডেঙ্গুর কার্যকর ও নিরাপদ কোনো ভ্যাকসিন পাওয়া যায় কি?
ডা. লেলিন চৌধুরী : ১৯২০ সাল থেকে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা সকলেই জানি, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি উপধরন। ডেঙ্গু ভ্যাকসিন তৈরির প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো, একটি ভ্যাকসিন দিয়ে ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি উপধরনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা ক্ষমতা তৈরি করা। অনেক চেষ্টার পর ২০২২ সালের শেষ নাগাদ জাপানের টাকেদা ফার্মাসিউটিক্যাল একটি ভ্যাকসিন তৈরিতে সমর্থ হয়। এই ভ্যাকসিনটি ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি উপধরনের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রতিরোধ তৈরি করে। থাইল্যান্ডের মাহিদল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই ভ্যাকসিনটির বৈজ্ঞানিক ফর্মুলা আবিষ্কার করে। এই ভ্যাকসিনের বাণিজ্যিক নাম হচ্ছে ‘কিডেঙ্গা’।
[৩] কোনো দেশে কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে কি?
ডা. লেলিন চৌধুরী : ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, আইসল্যান্ড, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, থাইল্যান্ড ইন্দোনেশিয়াসহ আরও বেশকিছু দেশে কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ইন্দোনেশিয়াতে এই ভ্যাকসিনের গণটিকাদান শুরু হয়েছে।
[৪] কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন কোথায় দিতে হয়? এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি?
ডা. লেলিন চৌধুরী : কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন শরীরে ত্বকের নীচে ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয়। পৃথিবীতে যতো রকম ওষুধ পাওয়া যায় তার প্রতিটিরই কমবেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। কিউডেঙ্গার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। তবে সেগুলো তীব্র বা জীবনঘাতি নয়, অধিকাংশই মৃদু। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ ইনজেকশনের স্থানে ব্যথা, লাল হয়ে যাওয়া, ফুলে উঠাসহ শরীরে মৃদু চুলকানি, মাথা কিছুটা ঝিমঝিম করা ইত্যাদি। কারও কারও কিছুটা জ্বর বা শরীর ব্যথা হতে পারে।
[৫] কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন নিয়ে কেউ কি মারা গিয়েছে?
ডা. লেলিন চৌধুরী : কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিনের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে অথবা ভ্যাকসিনের গণ-ব্যবহারের সময়ে বা পরে কোথাও ভ্যাকসিন গ্রহণকারীর মৃত্যুর মতো ঘটনার কথা জানা যায়নি।
[৬] কিউডেঙ্গা কয় ডোজ নিতে হয়? প্রতিরোধ ক্ষমতা কতোদিনের জন্য তৈরি হয়?
ডা. লেলিন চৌধুরী : কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিনের দুটো ডোজ নিতে হয়। প্রথম ডোজ নেওয়ার তিনমাস পরে দ্বিতীয় ডোজ নিতে হয়। এই ভ্যাকসিন চার ধরনের ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে জীবনব্যাপী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। এই ভ্যাকসিন ডেঙ্গুর লক্ষণ ও উপসর্গ ৮০.২ শতাংশ এবং হাসপাতালে ভর্তি ৯০.৪ শতাংশ কমায়। ছয় বছর ও তার বেশি বয়সের সবাইকে এই ভ্যাকসিন দেওয়া যায়। ইন্দোনেশিয়াতে ছয় থেকে পয়তাল্লিশ বছর বয়েসীদের কিউডেঙ্গা দেওয়া হচ্ছে।
[৭] বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কি কিউডেঙ্গা ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে?
ডা. লেলিন চৌধুরী : কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন ব্যবহারের জন্য এখনো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দেয়নি। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মেডিক্যাল বিষয়ক সংস্থা এই ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। প্রায় চব্বিশটির মতো দেশে ভ্যাকসিনটি অনুমোদন পেয়েছে। করোনা ভ্যাকসিন ব্যবহারের সময় দেখা গিয়েছে বৈজ্ঞানিকভাবে নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হওয়ার পর দেশে দেশে করোনা ভ্যাকসিন ব্যবহৃত হয়েছে। সেজন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন দরকার হয়নি বা অনুমোদনের জন্য কোনো দেশ অপেক্ষা করেনি। অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহারের বেশ পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দিয়েছে। তাই সামগ্রিক বিবেচনায় কিউডেঙ্গা ব্যবহার করা যেতে পারে।
[৮] ডেঙ্গুর আর কোনো কার্যকর ভ্যাকসিন আছে কি?
ডা. লেলিন চৌধুরী : ইউএসএ-র সানোফি ফার্মাসিউটিক্যালস ও ফ্রান্সের লুই পাস্ত্যুর ইনিস্টিউট যৌথভাবে একটি ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছে, যার বাণিজ্যিক নাম হচ্ছে ‘ডেঙ্গভ্যাকসিয়া’। যারা আগে অন্তত একবার ডেঙ্গু দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে কেবলমাত্র তাদের শরীরে এই ভ্যাকসিনটি প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারে। যারা ডেঙ্গু দ্বারা আগে সংক্রমিত হয়নি তাদের শরীরে এই ভ্যাকসিন ডেঙ্গুর তীব্র উপসর্গ তৈরি করতে পারে। তাই এই ভ্যাকসিনটি গণটিকা দানের উপযোগী নয়। এছাড়া ভারতের প্যানাসিয়া ফার্মাসিউটিক্যালস ও সেরাম ইনস্টিটিউট যৌথভাবে একটি ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল করছে। হয়তো দ্রæত এই ভ্যাকসিন তৈরির পর্যায়ে চলে আসবে।
[৯] আমাদের দেশের জন্য কোন ভ্যাকসিন দেওয়া সঠিক হবে?
ডা. লেলিন চৌধুরী : এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ধারণা করা হচ্ছে, আমাদের দেশে ডেঙ্গুর গণটিকা দেওয়ার জন্য কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন সর্ব অর্থেই উপযোগী। তবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা বৈজ্ঞানিকভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশে কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল দিতে হবে। দুটোর ফলাফল বিশ্লেষণ করার পরেই কেবল সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। কর্তৃপক্ষের আগ্রহ থাকলে এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হলে আগামী ডেঙ্গু মৌসুমের আগেই ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন পাওয়া সম্ভব। প্রবল প্রত্যাশা নিয়ে জনসাধারণ ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য দিন গুণতে শুরু করেছে।