কোভিডের পর রুশ অর্থনীতি অথবা বিশ্ব অর্থনীতি : ভবিষ্যৎ বিশ্বের মোড়ল কোন দেশ?
ওয়াসি মাহিন
পরাশক্তির কাতারে আমার কাছে তিনটি দেশ পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া। যদি দেশগুলোর ইতিহাস ঘাটেন, পররাষ্ট্রনীতি ঘাটেন, তবে খেয়াল করবেন যে রুশদের প্রকৃতি হলো, ‘রিস্ক টেকার’! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাল ফৌজের ভ‚মিকা, পরবর্তী সময়ে মহাকাশ অভিযানে সবার আগে ঝুঁকি নেওয়া, কেজিবির ভ‚মিকা সব মিলিয়ে রুশদের প্রকৃতি আমার নিকট মনে হয়েছে ঝুঁকি নিতে পারে তারা। আর এজন্যই ইউক্রেনকে আক্রমণ করে বসেছে তারা। আক্রমণের বিকল্প ছিলো। বিষয়গুলোকে ঠাÐা মাথায় হ্যান্ডেল করার সুযোগ ছিলো। যদি চাইত মাদার রাশিয়া সেন্টিমেন্টে ওলেগের ইউক্রেন রুশ ভ‚খÐে যুক্ত করতেই হবে তবে ইউক্রেনীয়দের মতামতের উপর প্রভাব বিস্তারে ত্রাতার ভ‚মিকা রাখতে পারত। ঐতিহাসিক সেন্ট পিটার্সবুর্গের আক্ষেপ মেটাতে ক্রিমিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে অন্য পদ্ধতিতে চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু রিস্ক টেকার বলেই তারা এতকিছুর ধার ধরেনি বলে মনে হয় আমার কাছে।
যদি আমেরিকার কথা বলা হয় তবে বলতে হবে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ভ‚খÐের পূর্ণ সুবিধা তারা কাজে লাগিয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আঁচ তারা পায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও মার্কিন ভ‚খÐ যুদ্ধ দেখেনি। ক্ষতি যা হয়েছে ইউরোপের, রাশিয়ার এবং এশিয়ার। সব দেশ যখন নিজেদের শক্তি ক্ষয় করে ফেলেছে তখন মার্কিনিরা অন্যদের থেকে বেশ এগিয়ে গেছে। বিশ্ব মোড়লে রূপ দিয়েছে। প্রকৃতিগতভাবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে মনে হয়েছে দম্ভের ছোয়া রয়েছে। পাড়ার নতুন বড়লোক হঠাৎ টাকা পয়সার মালিক হলে যেটা করে অথবা ভাত না পাওয়া নতুন পাবলিক যখন রাজনৈতিক পোস্ট আর ক্ষমতা পেয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে সবখানে তিনি যে বিশেষ কেউ, তার যে ক্ষমতা আছে সেটা সবাইকে জানান দেবার চেষ্টা করে, মার্কিনিদের অনেকটা এরকম মনে হয়েছে। নবীন দেশ।
সমৃদ্ধ ইতিহাস না থাকার আক্ষেপ মেটাতে ক্ষমতা পেয়ে সারাবিশ্বে জানান দিয়ে যাচ্ছে যে তারা ক্ষমতাধর। এক্ষেত্রে তারা বেশ ভালো কিছু পলিসি ফলো করে। বিশ্বের মেধাগুলোর গন্তব্য তাদের দেশে। তাদের গবেষণায় অংশ নেয় সারা বিশ্বের মানুষ। কসমোপলিটান সিটির মতো বলতে হয় কসমোপলিটান দেশ।
চীনের ক্ষেত্রে ভ‚মিকাটা রহস্যজনক মনে হলেও শি জিন পিংয়ের দর্শনে ঝুকি নেওয়ার থেকে ব্যাবসার বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পায়। ছরহম ডাইনাস্টি সর্বশেষ নিষিদ্ধ তিব্বতে মাঞ্চুরিয়ান পাপেট সম্রাটের পতন ও সমাজতন্ত্রের উত্থানের পর মাও সে তুং এর সময় ও চীন বেশ মাথা গরম রিস্ক টেকার ছিলো। বলশেভিক বিপ্লবের বাতাস তাদেরকেও স্পর্শ করেছিলো ভাবাদর্শের মিলে। কিন্তু চীন পরবর্তীতে নিজেদের মত সমাজতন্ত্রের নতুন রূপ দিতে পেরেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে চীনকে পিউর বিজনেসম্যান বললে ভ‚ল হবে না। যুদ্ধ বাধানোর মত ঝুকি চীনের দিক থেকে কম। তবে হুমকি ধামকি দিয়ে নিজেদের উত্থানের জানান দেয়ার কাজ তারা ভালোই নকল করতে পেরেছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমন করবে না। বিকল্প উপায় দেখবে।
আমার ধারণার পিছে কারণ ছিলো, কোভিডের পর রুশ অর্থনীতি অথবা বিশ্ব অর্থনীতি কোনটায় আরেকটা ভয়ঙ্কর যুদ্ধের ধকল নিতে পারবে না। যদি এরকম এক্সট্রিম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে তবে সেটা হবে মাথা গরম করা শিশুসুলভ বাজে সিদ্ধান্ত। একান্তই নিজের ভাবনা আর কি। অবাক হলাম যখন ধীরে ধীরে বাইডেন সাহেব প্রতিদিন জোতিষির ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হলেন। একটা দেশের উচ্চ মহল থেকে প্রকাশ্যে বারবার ঘোষণা আসবে যে, অমুক তারিখ রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করবে, সর্বশেষ গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী অমুক তারিখ আক্রমণ কনফার্ম। কী বিশ্রি একটা অবস্থা। অনেকটা রাশিয়াকে আক্রমণ করবার জন্য প্রভোক করার করা যাকে বলে। বাইডেনের সিদ্ধান্তগুলো দেখে মনে হয়েছে, উনি এখনো ৭০ দশকের দর্শন মনে প্রাণে ধারণ করে চলেছেন। কোল্ড ওয়ার ইগো বিটুইন এক্স কেজিবি চিফ এন্ড মার্কিন ফেলা। এটা নিশ্চিত বলতে পারি যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ভাবতে পারেনি তাদের ভ‚খÐ সরাসরি বহিঃআক্রণের স্বীকার হবার সম্ভাবনা কম থাকলেও বিশ্ব এখন আগের অবস্থাতে নেই। এখন বিশ্বের এক প্রান্তের সঙ্গে অন্য প্রান্তের দূরত্ব কমেছে। নির্ভরশীলতা বেড়েছে।
কেউ কাউকে ছাড়া চলতে পারে না। ইন্টার ডিপেনডেন্সের ইফেক্ট মার্কিনিদের উপর ভালোই পড়েছে। ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম পলিসি রেট বাড়ানোর পরেও ডলারকে স্টাবল করতে পারছে না। মুদ্রাস্ফীতি চরমে। সাধারণত কোনো বৃহৎ প্রতাপশালী সম্রাজ্যে পর পর দুই তিনটি খারাপ উত্তরসূরি আসলে সম্রাজ্যের টিকে থাকা হুমকিতে পড়ে। চীন ডাইনাস্টি উত্তম উদাহরণ। হান ডাইনাস্টি ৪০০ বছর শাসনের পর এই একি কারণে পতন হয়েছিলো। মঙ্গল সম্রাজ্য টেকেনি। সুরি সম্রাজ্য টেকেনি। যেহেতু এখন খান, রাজা বাদশাহের যুগ নেই তাই ইতিহাস ইতিহাসেই থাক। তবে বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব যথেষ্ট কমেছে। এর কারণ অর্থনৈতিক দুর্বলতা। এশিয়ার অর্থনৈতিক উত্থান চীনকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। ওবামা পর্যন্ত ঠিক ছিলো। ট্রাম্পের পরে বাইডেন। এরপর আরও একটা দুইটা এরকম প্রেসিডেন্ট আসলে মোটামুটি আমরা ওয়ার্ল্ড অর্ডারে পরিবর্তন দেখব বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক: ব্যবসায়ী