আমরা যে উন্নয়ন চেয়েছিলাম
মুজিব রহমান: আমরা এমন একটা টেকসই উন্নয়ন চেয়েছিলাম যেখানে একজন সরলমনের মানুষও যেন ধুরন্ধর পুঁজিবাজদের মাঝে কিছু করে খেতে পারে। পুঁজিবাজরা সুযোগ না দিলেও রাষ্ট্র যেন হাত বাড়িয়ে দেয়। নারায়ণগঞ্জের সাথে যেন কুড়িগ্রামও উন্নয়নের দৌড়ে সামীল হয়। গ্রাজুয়েশন করা একজন যেন এতটুকু বিকশিত হয় যাতে সে একটি সুন্দর জীবন লাভ করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেনো ছিনতাই ও চাঁদাবাজিতে না জড়ায়। মানুষের যেন ভোটাধিকার ও মানবাধিকারটা থাকে। যেনো নেতার কাছে জবাবদিহিতা চাওয়া যায়। ভোট না থাকলে নেতাতো আমাদের পাত্তাই দিবে না। উন্নয়ন দূর থেকে দেখা যাবে কিন্তু ছোঁয়াতো যাবে না। দেশে একটা ভালই দালাল চক্র তৈরি হয়েছে, তারা আবার বলবে, একদিনের গণতন্ত্র নিয়ে লাভ কি? ভোট দরকার না, উন্নয়ন দরকার! পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক দেশ ৭১টি এরমধ্যে পূর্ণগণতিন্ত্রিক দেশ ১৯ বা ২০টি। বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম! বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থাকে বলে হাইব্রিড শাসন ব্যবস্থা। হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা বলতে এমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে প্রায়ই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। আমরা উন্নয়নের কোথায় আছি?
আমাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ নেতাকে দেখছি অনবরত মিথ্যাচার করতে। আমি তার দলের কয়েকজন কর্মীর কাছে এমন মিথ্যাচারের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলাম। দেখলাম ওরাও লজ্জা পাচ্ছে। দুএকজন আবার অন্য দিকেও আঙুল তুলল এবং অন্যদের অন্য বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলল। গতকাল একজন বাস হেল্পার আক্ষেপ করে বলল, আমাদের রাজনীতির ভবিষ্যৎ দুর্নীতিগ্রস্থ বা মাদকাসক্ত। ওনি যে কি বলতে চাইলেন তাতো আমার মনে হয় বুঝেছি, বাসের সবাই হয়তো বুঝেছে। কিন্তু স্পষ্ট করে কারো কথা বলার সাহস নেই। আমরা কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছি। আমরা জানি দেশে এমন কিছু আইনের ভয়ানক প্রয়োগ রয়েছে যা আমাদের আতঙ্কিত করে ফেলেছে। বিদেশি রাষ্ট্রদূত যখন বলে, ‘রাতের ভোটের কথা বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও শুনিনি’ তখন উন্নয়ন বজ্রাঘাত করে।
সাধারণ মানুষের দিনবদল কতটুকু হয়েছে? আমাদের চোখের সামনে পুকুরগুলো প্রথমে জাল দলিলে মালিকানা বদল হয়ে যাচ্ছে এরপর জলাশয় ভরাট আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তা ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আমরা সারা দেশে অসংখ্য বালুর মাঠ দেখছি। নদীর তীরগুলোতে লেগে আছে একটার পর একটা ড্রেজার। আড়িয়াল বিল দেখতে গিয়ে দেখলাম, একটার পর একটা বালু ভর্তি বিশালাকার কার্গু যাচ্ছে জলাশয় ভরাট করতে। ধাক্কা দিয়ে আমাদের ছোট ময়ুরপঙ্ক্ষীকে প্রায় ডুবিয়ে দিচ্ছিল। বন্ধু নাসির বলল, নদীতে সারারাত ভরেই বালু কাটে। কোথায় বালুমহাল আর কোথায় কাটে? উপজেলাগুলোতে এখন আলিশান ধর্মশালা শোভা পাচ্ছে। একদা ঢাকাকে বলা হতো মসজিদের শহর, এখন বাংলাদেশকেই বলা যাবে মসজিদের দেশ। এবার বিস্ময়ের সাথে থানায় থানায় দেখলাম লেখকদের সরকার ঘটা করে ক্রেস্ট দিচ্ছে। এর আগে জেলায় জেলায় দিয়েছে। এরপরে হয়তো ইউনিয়নে ইউনিয়নে বা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডেও দেয়া হবে।
বিভ্রম দেখতে দেখতে সত্যিটাকেও বিভ্রম মনে হয়। মনে হয় ভোটের কি দরকার, উন্নয়নই যদি লক্ষ্য হয় তবে এক্সপ্রেস ওয়েই হোক! একটা বিভ্রম তৈরি হয়। মনে হয় ১৮ কোটি মানুষের দেশে যেনো ১৮শ এক্সপ্রেস ওয়ে আছে! আমরাতো চেয়েছিলাম, মাধ্যমিক পাস করা একটি ছেলে জীবন চালানোর মতো শিক্ষা অর্জন করবে। মাধ্যমিকের শিক্ষার মান নিয়ে আমরা এখন হতাশ। স্কুলে স্কুলে এখন উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সুযোগ। কিন্তু পড়াবে কে? খÐকালীন দিয়ে কি শিক্ষা চলে? শিক্ষকরা তাদের বেতনে কি চলতে পারে? তারা বাঁচার জন্য প্রাইভেট পড়ানো নির্ভর। এই শিক্ষক দিয়ে যে, সৃজনশীল শিক্ষা হবে না সেটা বুঝতে অনেক দিনই সময় লেগে গেল। শিক্ষকের মানের উন্নয়ন না ঘটিয়ে আসলো ভিন্ন পদ্ধতি। সেই শিক্ষক যারা সৃজনশীলে মানিয়ে নিতে পারেনি তারা কি পারবে নতুন পদ্ধতিতে মানিয়ে নিতে? তামা পিটিয়ে সোনা বানানো যাবে কি?
অনেকেই ভুলে গেছেন যে, আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছিল গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য। যদি ৭০ এর নির্বাচনে বিজয়ী দলের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দেয়া হতো তাহলে ইতিহাস ভিন্নভাবেই লেখা হতো। তখন হয়তো পাকিস্তানিরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতো। অবশ্য তাতে কম সময়েই তারা স্বাধীনতা পেয়ে যেতো। অনেকেই আমাদের ভিন্ন ইতিহাস শেখাতে চায়। আমরা দেখি সিঙ্গাপুরের একজন সেরা ধনি কেবল বাংলাদেশেই ব্যবসা করেন। কি পরিমাণ বাণিজ্য করে টাকা সিঙ্গাপুরে নিতে পারলেই না তিনি ওখানকার সেরা ধনিদের একজন হবেন? একজন ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে দেখেছিলাম দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ। একদিন দুদকের চিঠিতে দেখলাম, একজন এমপি আমেরিকায় ১০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। তিনি অবৈধ অর্থে আমেরিকায় ৬টি বাড়ি ও ১০ একর জমি কিনেছেন? এরপর আরেকজনের, আরেকজনের….! কিন্তু দুদকের কর্মকাÐতো আর চোখে পড়ছে না। ছাত্র নেতারা এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হয়ে, রাস্তা থেকে লেগুনা ধরে আনছে চাঁদাবাজি করতে। যদিও দেশে এখন ছাত্ররা কোন নেতাও নির্বাচিত করেন না। তবুও দেশে ছাত্রনেতা আছে! ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া ছাত্রীদের ৪১ শতাংশই দশম শ্রেণির আগেই ঝরে যায়। দেশের ২৪ ভাগ শিশু খর্বকায়। এসব শিশু মারাত্মক অপুষ্টির শিকার।কারো মাথাব্যথা আছে?
এমন সব কিছুতেই উন্নয়ন দেখানো যায়। অনেকেই ধনি হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে হঠাৎ ধনি হওয়াদের হার দ্রæতই বেড়েছে। এটাকেও উন্নয়ন বলে বিভ্রম হয়। এতো উন্নয়নের মধ্যে অনেকে প্রশ্ন করে বসেন, ‘আমরা কি এমন উন্নয়ন চেয়েছিলাম?’ টেকসই না হলে রিজার্ভ দুই বছরে অর্ধেকে নেমে আসতে পারে। আমরাতো চেয়েছিলাম শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতটা রাষ্ট্র দেখুক। চিকিৎসা নিতে গিয়ে একেকটা পরিবার ফতুর হয়ে যাচ্ছে।
উন্নয়নের চাওয়া ও পাওয়ার হিসাব মিলাতে পারি না। ডাক্তারগণ প্রতিবছর দেশের অন্তত ১০ লক্ষ মায়ের খামোখাই শুধু টাকার জন্য সিজার করে। খামোখা সিজার করা কসাই ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় না। ডাক্তারদের এই প্রবনতা বন্ধকেই উন্নয়ন বলতে চাই? হচ্ছে নাতো! অভিযোগ রয়েছে, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠোর আইনগুলো রয়েছে বাংলাদেশে যা জনসাধারণের বিরুদ্ধে অন্যায্যভাবে প্রয়োগ হয়। ডিজিটাল সুরক্ষা আইনের মতো আইনগুলো না থাকাকেই উন্নয়ন বলতে চাই।
বিশ্বের বিপজ্জনক শহরের মধ্যে ঢাকা সপ্তম। ঢাকার বাতাস পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম খারাপ। বসবাসের অযোগ্য শহর হিসাবে বিশ্বে ৪র্থ স্থান। ভয়াবহ ক্ষতিকর সালফার ডাই-অক্সাইড বা কার্বন মনো-অক্সাইড নির্গমনেও ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষে। এগুলোকে উন্নয়ন বলতে চাই না। সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহারে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে থাকাতো উন্নয়ন নয়। বাংলাদেশের ৫১% মেয়ে বাল্য বিয়ের শিকার হয়। পৃথিবীতে বাল্যবিবাহ কমলেও বেড়েছে বাংলাদেশে। পরিবেশ সুরক্ষায় ১৮০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১৭৭! আইনের শাসনে আমরা ১৪০ টি দেশের মধ্যে ১২৭ তম! এগুলোতো উন্নয়ন বলবো না।
গত ষোল বছরে ১১ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। কারা করলো? কেবল শুনি ফিরিয়ে আনবো। কিন্তু ফিরিয়ে আনতে না পারলে বা পাচার বন্ধ করা না গেলে কিভাবে টেকসই উন্নয়ন হবে। ঋণ করে ঘি খেয়ে কতটুকু উন্নয়ন সম্ভব। ঋণ ও ঘি দুটোই যখন ক্ষতিকর! এর ফলে বাংলাদেশে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় বাড়ে বিপুল হারে আর সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষের আয় কমে যায়।
যৌন সহিংসতায় বাংলাদেশ বিশ্বে ৪র্থ। দেশে প্রতি বছর ৪ থেকে ৫ হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হন। গত এক যুগে ধর্ষিতা নারীর ৯৭ ভাগই কোন বিচার পাননি। পরিবারের মধ্যে নারীদের প্রতি যৌন সহিংসতা সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে! উন্নয়ন এসব বাদ দিয়ে হবে?
সবচেয়ে কম মজুরী প্রদানে এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে। গার্মেন্টস রপ্তানি দেশগুলোর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিবেশে পৃথিবীতে শীর্ষে। এক দশকে কর্মক্ষেত্রে ৮ হাজার শ্রমিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আহত হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। খেলাপী ঋণে উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। দেশে গত এক দশকে খেলাপি ঋণ হয়েছে চারগুণ! সবচেয়ে খারাপ রাস্তার তালিকায় এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষে শুধু নেপালের আগে। মিডিয়ায় ব্যাংকিং বিষয়ে সঠিক প্রকাশ হয় না। মিডিয়া নিজেও মহা সমস্যায়। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (আরএসএফ) ২০২২ সালের রিপোর্ট মতে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১০ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ১৮০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম!
মানুষের মধ্যে আয়বৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে। বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে গিনি সহগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৪৯৯ পয়েন্ট। ২০১৬ সালে গিনি সহগ ছিল ০.৪৮২ পয়েন্ট। সাধারণত ০.৫০০ হলেই একটি দেশকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সূচককে ১০০ দিয়ে গুণ করলে পয়েন্ট হয়।
দরিদ্র শিশুদের জন্য মেগা কোন প্রকল্প দেখিনি অথচ খাতিরের প্রকল্প দেখছি। শিশুরা কিভাবে সবল হয়ে উঠবে— সে প্রকল্প কোথায়? মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পর্যাপ্ত যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের প্রকল্প কোথায়? কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-সংসদ ফিরিয়ে দিন। ছাত্রনেতারা লেগুনা আটক বন্ধ করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক। মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হোক অবারিত। যাতে সত্যিই উপলব্ধি করি উন্নয়নের। উন্নয়ন যেনো কথার কথা আর ইটপাথরে বন্দী না থাকে!