
দেশের খারাপ পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি কতটুক

ওয়াসি মাহিন: বাংলাদেশের মানুষ মোটামুটি সব পরিস্থিতিতে সহনশীল। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যা, ৯৮ সালের দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, ২০০৭ সালের সিডর ও ০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার পর ২০১৭ সালে যখন অর্থনীতি নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগে বেশ ভাল রকমের বেকায়দায় পড়েছিল, তখন অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন যে প্রতি ১০ বা ১২ বছর পর পর আমাদের ইতিহাস বলে প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা বিভিন্ন কারণে আমাদেরকে খুব বাজে একটি বছর কাটাতে হয়। ইতিহাস এমন হলেও এর বাস্তবতা নেই। পরিসংখ্যান সম্ভাবনার কথা বলে বাস্তবতার নয়। বিশ্বাস করার প্রশ্ন নেই। তবে ২০১৭ এর পর ২০২০ সাল থেকে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বকে বেশ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে।
২০২০ সুস্থ স্বাভাবিক বছর ছিলনা। ২০২১ ও কোভিডের ছোবলে বিষাক্ত। নাজুক পরিস্থিতি যখন একটু স্বাভাবিক হওয়া শুরু করেছিল ঠিক তখন বৈশ্বিক স্বাপ্লাই চেইনকে নষ্ট করে দিল রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ।
বাংলাদেশের সামনের দিনগুলির চ্যালেঞ্জ আরো কঠিন। এর প্রধান কারন হল আমাদের রপ্তানি বাজারগুলি এখন অস্থিতিশীল। ইউরোপ, আমেরিকা যদি রেসিশন ছাপিয়ে ডিপ্রেশনে যায় তবে এর ডমিনো ইফেক্ট আমাদের অর্থনীতিতেও লাগবে। ইউরোপে বাংলাদেশের সবথেকে বড় গন্তব্য জার্মানির ইকোনমি দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির দেখা পাবেনা বলে ফোরকাস্ট করা হচ্ছে। অন্য রপ্তানি বাজারেও ভাল সংবাদ নেই। ইতোমধ্যে গার্মেন্টস এর অর্ডার কমে গেছে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাটাই করছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।
গার্মেন্টসসহ অন্য রপ্তানি পণ্যে আশঙ্কার সময় বড্ড অসময়ে বাংলাদেশ অবকাঠামো ঘাটতিজনিত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছে। এর মূল চালিকা হিসাবে রয়েছে পদ্মা সেতু। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর রয়েছে মংলা, বেনাপোল, ভোমরা, নোয়াপাড়া, পায়রা। বন্দরগুলিকে দ্রæত সংযোগ নিশ্চিত করে কিছুটা সুবিধাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যেত। মংলার সাথে ঢাকা দুরত্ব কমে হয়েছে ১৭০ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার কম। এইচ এন্ড এম এই বন্দর ব্যাবহার করে পোশাক রপ্তানি শুরু করেছে। এর প্রধান কারন হল খরচ কম, এবং লিড টাইম কম হওয়া। কোভিডের সময় একটা বড় সমস্যা সৃষ্টি হয়। জাহাজ ভাড়া ভেড়ে তিন বা চার গুন হয়ে যায়। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ দ্রæত সিদ্ধান্তে ইউরোপ ও অন্যান্য গন্তব্যে ডিরেক্ট রুট চালু করে। ফলে কলোম্বো ও সিঙ্গাপুর বন্দরকে বাইপাস করে সময় ও খরচ বাঁচানোর একটি পথ সৃষ্টি হয়। ৬০ দিনের যাত্রা কমে ১৫-২০ দিনে নেমে আসে। কিন্তু এই সুবিধার বেনিফিট কাজে আশার সুযোগ সীমিত হয়ে এসেছে বৈশ্বিক অস্থিরতায়।
সম্ভাবনার দোলাচলে ইতিহাস রিপিট হতে থাকলে ২০২৬-২৮ এর ভেতর এরকম বাজে একটি বছর আসতে পারে। সেক্ষেত্রে এই দশকে ইকোনমিক হিলিং এর সুযোগ ও সময় আমরা নাও পেতে পারি।এই মুহুর্তে আইএমএফ এর কাছে ঋন চাইবার ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যালান্স অব পেমেন্ট বাফার সৃষ্টি করতে গিয়ে ইতো মধ্যে বøæমবার্গের অরুপ দেবনাথের একটি রিপোর্টের ইম্প্যাক্ট ঠিক কতটা হয়েছে সেটা বুঝার প্রয়োজন রয়েছে। খ্যাতনামা পত্রিকা দ্যা গার্ডিয়ান, ভারতের ইন্ডিয়ান টাইমস সহ মোটামুটি এখন সবখানে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত যে বাংলাদেশ ঋণ খেলাফির দ্বারপ্রান্তে। আইএমএফ এর ঋণ দীর্ঘমেয়াদে সুফল আনবে না। সমস্যা বুঝতে পারা সমাধানের অর্ধেক। বর্তমানে এই পরিস্থিতি অস্থায়ী। এক সময় কেটে যাবে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলিতে সিদ্ধান্তে আসা জরুরি।
হুন্ডি মোকাবেলা ছাড়া বিকল্প নেই। একটা বিষয়ে অল্প বিস্তর বলে রাখা ভাল। ধরুন রেমিটেন্সে গভর্নমেন্ট বোনাস ২.৫ শতাংম থেকে বাড়িয়ে ৫ বা ৬ শতাংশ করল। সল্পমেয়াদে টাকা পাচারকারিদের একটু সমস্যায় পড়তে হবে। তবে আবার তারা এডজাস্ট করে নিবে। কিভাবে? এরকম ঘোষনা আসলে রেমিটেন্স বৃদ্ধি পাবে। তবে সেটা স্থায়ীভাবে নয়। এর কারন হল, এই সিদ্ধান্ত রপ্তানিকে কলুষিত করবে। ধরুন ১০০ ডলার রপ্তানি করা হল। রপ্তানিকারন বাড়তি সুবিধার আশায় তখন রপ্তানি দেখাবে ৫০ ডলার। বাকি ৫০ ডলার রেমিটেন্স এর নামে দেশে আনবে এবং বাড়িতি ৫ শতাংশ এর সুবিধা নিবে। অনেক ক্ষেত্রে এই বাড়তি বোনাসের সুবিধা ভোগ করতে ভুয়া রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। তাহলে এর সমাধান কি?
সমধানের ক্ষেত্রে এর আগেও অনেক বলেছি, বাজার উদার করতে হবে। কনজারভেটিভ এপ্রোচে কখনো সমাধান হয়নি হবেও না। আরব আমিরাত কে অনুসরন করা যেতে পারে এক্ষেত্রে। নিজেদের বাজার ঠিক রাখতে বিমসটেক, ডি-৮ এর আন্ত সহযোগিতা বাড়াতে হবে। আরসিইআরতে যুক্ত হতে হবে। আশিয়ানের সাথে আশিয়ান প্লাস চুক্তি করতে হবে। ট্রেড বেনিফিট এর জন্য বাজার উদার করার বিকল্প নেই। ইকোনমিক জোন গুলি প্রস্তুত হচ্ছে, আমাদের রক্ষণশীলতা এসব জোনে বিনিয়োগের গতি কমিয়ে দিলে আমাদের এগোবার গতি তো বৃদ্ধি পাবেনা।
হুন্ডি নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। হুন্ডির প্যাট্রোজাইনারদের খুজে বের করতে হবে। কঠোর আইন ও প্রয়োগের বিকল্প নেই। খেলাপি ঋন করে অনেকেই টাকা বিদেশে সরান। খেলাপি ঋনে ছাড় দেয়ার ঝোক কমাতে হবে। এক্ষেত্রে খেলাপীদের জাতীয় পরিচয়পত্র রিভোক করা যেতে পারে। সাথে পাসপোর্ট। সকল সেবা থেকে ঐচ্ছিক খেলাপিদের বঞ্চিত করতে হবে।ু
