ডিজিটাল নিরাপত্তার পরিবর্তে সাইবার নিরাপত্তা আইন নতুন আইনে কি কি সাজা জানালেন আইনমন্ত্রী
সোহেল রহমান : আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করা হচ্ছে। তবে পরিবর্তন করা হলেও বিদ্যমান আইনের বহু ধারা সাইবার নিরাপত্তা আইনে যুক্ত করা হবে। আর কিছু ধারায় বড় সংশোধনী আনা হয়েছে। সোমবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
প্রসঙ্গত- সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বদলে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়।
আইনমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় সাজা ছিল কারাদÐ। সেটাকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হচ্ছে। এখানে শুধু শাস্তি হবে জরিমানা। সর্বোচ্চ জরিমানা ২৫ লাখ টাকা। অনাদায়ে হয় ৩ মাস না হয় ৬ মাসের কারাদÐ থাকবে।
এটা কি সাধারণ মানুষের পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভবÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে কারাদÐ ছিল এ ধারায়। কারাদÐ উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। এখন শুধু সাজা রাখা হয়েছে। দেওয়ানি আইনে যদি মানুষ ক্ষতিপূরণ চায় তাহলে আমাদের যে আইন রয়েছে তাতে ক্ষতিপূরণের লিমিট নেই। আমি প্রশ্নের জবাবটা দিয়ে দিচ্ছি। ১০০ কোটি টাকাও ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে। সেসব ক্যালকুলেশন করে অনধিক ২৫ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে ১ টাকাও জরিমানা হতে পারে, ২৫ লাখও হতে পারে।
এ ধারায় জরিমানা আগে ছিল ৫ লাখ টাকা, এখন কেন ২৫ লাখ টাকা করা হচ্ছেÑ জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, এখানে অনধিক ২৫ লাখ করা হয়েছে। এটা বিজ্ঞ আদালতের ডিসক্রিশনের (আদালতের নিজের বিচক্ষণতা) ওপর ছাড়া হয়েছে। ডিসক্রিশনটা কীভাবে ব্যবহার করা হবে, আমি আইনজীবী হিসেবে যতটুকু জানি, অপরাধের পরিধি এবং তাতে যে ব্যক্তি মামলা করেছেন তার যে ক্ষতি হয়েছে তার পরিধি বিবেচনায় তিনি জরিমানাটা করতে পারবেন। সেটা এক টাকা থেকে শুরু করে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত করতে পারবেন। এখানে আমার মনে হয় না এটা অযৌক্তিক কিছু হচ্ছে।
জরিমানার পরিমাণ বেশি হয়েছে বলে আমরা মনে করি। এ ধারায় সাধারণ মানুষই বেশি অ্যারেস্ট হচ্ছে- সাংবাদিকদের এমন অভিমতের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, আমি দুঃখিত যে আপনার সঙ্গে আমি একমত হতে পারলাম না। তার কারণ হচ্ছে, এখানে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলা হচ্ছে অনধিক ২৫ লাখ টাকা। এটা ক্যাপ করে দেয়া হয়েছে যে, ২৫ লাখের ওপরে যেতে পারবে না।
তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এখন কোনো কারাদÐ নেই (খসড়া আইনে)। আপনাদের (সাংবাদিকদের) অ্যারেস্ট করবে কেন? অ্যারেস্ট তো করার আর কোনো সম্ভাবনাই থাকল না। তার মানে অ্যারেস্ট হচ্ছে না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, অ্যারেস্ট হবে না। তাহলে মানহানির মামলার ক্ষেত্রে সরাসরি অ্যারেস্ট করা যাবে না- এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, অবশ্যই, এটা তো আর কারাদÐই না।
প্রসঙ্গত- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় মানহানির বিচার করা হয়। এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে দÐবিধির ৪৯৯ ধারায় বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচার করেন, তার জন্য তিনি অনধিক তিন বছর পর্যন্ত কারাদÐ বা অনধিক ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কারাদÐে বা উভয় দÐে দÐিত হবেন। নতুন আইনে কারাদÐ বাদ দিয়ে জরিমানার সীমা ৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে ২৫ লাখ টাকা করা হয়েছে।
এদিকে সংশোধিত বা নতুন আইনের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বলেন, বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ পরিবর্তন করে নতুন আইন করার সিদ্ধান্ত নিলেও এ আইনে চলমান মামলাগুলো বাতিল হবে না। মামলাগুলোর বিচার আগের আইনেই চলবে।
তিনি বলেন, যখন কোনো আইন বাতিল বা পরিবর্তন করা হয়, সেখানে একটা সেভিং ক্লোজ দেয়া হয়। সেখানে বলা হয়, যে মামলাগুলো চলমান আছে সেই মামলাগুলোর ক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে এ আইনটা বিলুপ্ত হয়নি। এখন পর্যন্ত যত আইন বাতিল করা হয়েছে বা পরিবর্তন করা হয়েছে এ ধারা চলে আসছে।
সাইবার নিরাপত্তা আইনে কোন অপরাধের জন্য কী সাজা
বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম বাদ দিয়ে বিষয়বস্তুতে বড় পরিবর্তন এনে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে নতুন একটি আইন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, প্রস্তাবিত নতুন আইনে সাজা যেমন কমানো হয়েছে, তেমনি অনেকগুলো অজামিনযোগ্য ধারাকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। মানহানি মামলার জন্য কারাদÐের বিধান বাদ দিয়ে শুধু জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। মানহানির অভিযোগে মামলা হলে গ্রেপ্তার করা হয় না।
আজ সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে নতুন এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের কাছে প্রস্তাবিত আইনে কী কী আছে এবং কেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত ও পরিবর্তন করে নতুন আইন করা হচ্ছে এবং কবে নতুন আইনটি সংসদে উঠবে, তা জানান আইনমন্ত্রী। তবে মন্ত্রী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল না বলে পরিবর্তন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
আইনমন্ত্রী বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাইবার নিরাপত্তার জন্য যেসব ধারাগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছিল, সেই ধারা প্রস্তাবিত আইনে অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। তবে অনেকগুলো ধারা, যেমন মানহানির ধারায় আগে শাস্তি ছিল কারাদÐ। প্রস্তাবিত আইনে সেটি পরিবর্তন করে করা হয়েছে জরিমানা।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় মানহানির বিষয়টি রয়েছে। এতে বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে পেনাল কোডের (দÐবিধি) সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, সে জন্য তিনি অনধিক তিন বছর কারাদÐে বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লাখ টাকা অর্থদÐে বা উভয় দÐে দÐিত হবেন। আর যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১)-এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছর কারাদÐে বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদÐে বা উভয় দÐে দÐিত হবেন।
প্রস্তাবিত আইনে এই অপরাধের জন্য কারাদÐ বাদ দিলেও জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। এখন এই অপরাধের জন্য অনধিক ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, জরিমানা না দিলে তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ ছয় মাস পর্যন্ত কারাদÐ দেওয়া যাবে। কিন্তু অপরাধের মূল শাস্তি হলো জরিমানা।
আইনমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত আইনে অনেকগুলো ধারাকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য ছিল।
বিভিন্ন অপরাধের জন্য শাস্তি কমানো হয়েছে বলেও জানান আইনমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা-২১-এর কথা উল্লেখ করেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই ধারায় (২১) মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার জন্য দÐের বিধান রয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি এই অপরাধ করেন, তাহলে তিনি অনধিক ১০ বছর কারাদÐে বা অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদÐে বা উভয় দÐে দÐিত হবেন।
আইনমন্ত্রী বলেন, এই সাজা কমিয়ে এখন করা হয়েছে সাত বছর। এ ছাড়া অনেকগুলো ধারায় দ্বিতীয়বার অপরাধের জন্য সাজা দ্বিগুণ বা সাজা বাড়ানো ছিল। প্রস্তাবিত আইনে প্রত্যেকটি ধারায় যেখানে দ্বিতীয়বার অপরাধের ক্ষেত্রে বাড়তি সাজার কথা আছে, সেগুলো বাতিল করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা ২৮ ধারা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভ‚তিতে আঘাত করার বা উসকানি অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভ‚তি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে এই ব্যক্তির এই কাজ হবে একটি অপরাধ।
কোনো ব্যক্তি এই অপরাধ সংঘটন করলে তিনি অনধিক পাঁচ বছর কারাদÐে বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদÐে বা উভয় দÐে দÐিত হইবেন। আর এই অপরাধ দ্বিতীয় বার করলে সাজা আরও বেশি হবে।
প্রস্তাবিত আইনে এটি (২৮ ধারা) পরিবর্তন করে জামিনযোগ্য করা হয়েছে (আগে অজামিনযোগ্য ছিল) এবং সাজা কমানো হয়েছে। এখন এই অপরাধে সাজা হবে সর্বোচ্চ দুই বছর।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১ ধারাও পরিবর্তন করা হচ্ছে প্রস্তাবিত আইনে। এই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা স¤প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা স¤প্রদায়ের মধ্যে শত্রæতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটার উপক্রম হয়, তাহলে ওই ব্যক্তির অনধিক ৭ বছর কারাদÐ, বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদÐ বা উভয় দÐে দÐিত হবেন।
প্রস্তাবিত আইনে সাজা কমিয়ে ৫ বছর করা হয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধের বাড়তি সাজা বাতিল করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের জন্য অনধিক ১৪ বছর কারাদÐ বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদÐ বা উভয় দÐের বিধান ছিল। এটি কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে।
হ্যাকিংয়ের জন্য অনধিক ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদÐ বা অনধিক এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে একটি ধারায়।
এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন প্রস্তাবিত আইনে গণমাধ্যমের জন্য আলাদা কোনো বিধান রাখা হয়নি। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিদম্যান মামলাগুলো সাইবার নিরাপত্তা আইনে চলবে বলে জানান মন্ত্রী।
কবে নাগাদ নতুন আইনটি হবে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, আগেও বলেছি, এখনো বলছি আগামী সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসবে, সেই অধিবেশনে বিলটি সংসদে পেশ করা হবে। সেই অধিবেশনে আইনটি পাস হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন। তখন চলমান মামলাগুলো স্বাভাবিকভাবে সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীনে যাবে।
আইনমন্ত্রী বলেন, সাইবার অপরাধসংক্রান্ত কারিগরি বিষয়ের অপরাধের ক্ষেত্রে আইনে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। নতুন আইনে কোনো বিতর্কিত ধারা থাকবে কি না, সেটি পরে সংশোধন হবে কি না, জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, নতুন আইনটি নিয়ে কোনো বিতর্ক হবে না এবং এটি সংশোধনের প্রয়োজন হবে না বলে মনে করেন তিনি। সূত্র : প্রথম আলো