শক্তিশালী বাংলাদেশ বিনির্মাণে সমুদ্র অর্থনীতি
ওয়াসি মাহিন
১৪৯২ সালে স্পেনে মুসলিমদের চ‚ড়ান্ত পরাজয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ মুসলিম সালতানাতের সকল জ্ঞান ভান্ডার তখন রানী ইসাবেলার কব্জায়। শুরু হলো বিশে^র সব থেকে শক্তিধর দেশ হিসাবে স্পেনের নতুন যাত্রা। সমুদ্র ব্যবহার করে স্প্যানিশরা নতুন বিশ্বের সন্ধানে মহাদেশ থেকে মহাদেশে। ভালওয়াদের হাতে তখন ক্ষয়িষ্ণু শক্তি ফ্রান্স। এদিকে ইংল্যান্ডে তখন চলছে রানী প্রথম এলিজাবেথের শাসন। প্রটেস্টান্ট ইংল্যান্ডের শত্রæ ক্যাথলিক ফ্রান্স এবং স্পেন। যেকোনো সময় পরাজয়ের স্বাদ নিতে হতে পারে রানী এলিজাবেথের ইংল্যান্ডকে। ভীত রানীর দোরগোড়ায় কুইন মেরির স্কটিস রাজ্য। কিন্তু ইতিহাসে নতুন একটা অধ্যায় শুরু করে দিলেন রানী এলিজাবেথ।
স্প্যানিশরা যখন হুমকি দিয়ে রাখলো ক্যাপ্টেন হকিন্সকে বন্দী করার, রানী হকিন্সকে ডেকে শুনলেন ইউরোপের বাইরের নতুন বিশে^র কথা। ভারত, চীনসহ পৃথিবীরর বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে ইংল্যান্ডের সমুদ্র অভিযানের সম্ভাবনা। রানী নির্দেশ দিলেন নতুনভাবে নতুন বিশ্ব আবিষ্কারের জন্য। শুরু হলো রয়াল নেভির যাত্রা যাদের কাজ ছিলো সারাবিশ্বে নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার। শক্তিশালী হতে থাকলো ইংল্যান্ড। যার ফলাফল ১৫৮৮ সালে স্প্যানিশ আর্মাডার পতন, তাও ভঙ্গুর ইংল্যান্ডের হাতে। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। ব্রিটিশ সম্রাজ্য এতোটাই বিস্তৃত ছিলো যে বলা হতো ব্রিটিশ সম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্তমিত হয় না।
সমুদ্রে প্রভাব একটি দেশের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা ইতিহাস ঘাটলে অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ হলেও প্রাকৃতিকভাবেই বাংলাদেশর রয়েছে বিশাল সমুদ্র। কিন্তু ঠিক কতোটুকু কাজে লাগাতে পারছি আমরা? বার্মা এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্র জলসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির আগে বাংলাদেশর সমুদ্র ছিলো মাত্র ৪০,০০০ বর্গ কিমি পর্যন্ত, যেটাতে কারো দাবি ছিলো না। আন্তর্জাতিক মেরিটাইম আদালতের রায়ে সেই ৪০০০০ বর্গ কিমির সমুদ্র রাতারাতি হয়ে যায় ১,১৮,৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের মতো। বলা যায় মূল ভ‚খÐের প্রায় সমান একটি অংশে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই বিশাল সমুদ্রকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ খুব বেশি অর্থনৈতিক সুবিধা এখনো আদায় করে নিতে পারেনি। সমুদ্র অর্থনীতি আসলে কী? মূলত সমুদ্রের সম্ভাবণার মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সমুদ্র অর্থনীতি বা বøু-ইকোনোমি বলা যায়। এর ভেতর কী কী আসতে পারে? সামুদ্রিক সম্পদ দেশের সম্ভাবনাময় শিল্প, যেমন মৎসসম্পদ আহরণ, এনার্জি, প্রযুক্তি, পর্যটন, গবেষণা, তেল-গ্যাস, মেরিন বায়োলজি, সাবমেরিন মাইনিং ইত্যাদি সেক্টরের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে।
ফলে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্র আরও স¤প্রসারণ হবে। আর বøু-ইকোনোমির অবকাঠামোগত উন্নয়ন হতে পারে সম্ভাব্য সব প্রকার সুবিধা অর্জনের মূলমন্ত্র। যদিও বাংলাদেশ এখন একদম প্রাথমিক অবস্থায় আছে। সমুদ্রে মৎস সম্পদ আহরণের মতো অবকাঠামোর যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে আমাদের। বাংলাদেশে ২০১৫ সালে বøু-ইকোনোমি সেল গঠন করা হয়েছে। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ২৫ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি দল গঠন করা হয়েছে। এ সেল বøু-ইকোনোমির সম্ভাব্য সব সুবিধা অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে। এখন সম্ভাবনার কিছু বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যাক।
মৎসসম্পদআহরণ: প্রতিবেশী দেশ ভারত ২০১৬ সালে সাগর থেকে মৎস আহরণ করেছে প্রায় ৪০ লাখ টন। আর সেখানে বাংলাদেশ আহরণ করেছে ১ লাখ টনেরও কম। গভীর সমুদ্রে মৎস শিকারের জন্য উচ্চ প্রযুক্তির ফিশিং ট্রলার না থাকায় বাংলাদেশকে উপক‚লীয় অংশে মাছা ধরা ছাড়া উপায় নেই। এই অবকাঠামো সমস্যা দূর করার জন্য স¤প্রতি ২০টির অধিক লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে যারা গভীর সমুদ্রে মৎস আহরণের উপযোগী ফিশিং বোট সংগ্রহ করে কার্যক্রম চালাবে। বর্তমানে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ৬৬৪ কিলোমিটার লম্বা। কিন্তু আমরা ব্যবহার করতে পারছি মাত্র ৬০ কিলোমিটার এলাকা। অর্থাৎ মাত্র ১০ ভাগ সমুদ্রসীমা আমরা ব্যবহার করতে পারি। সাগরের বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা ও কন্টিনেন্টাল সেলফ এলাকায় মাছ শিকার কিংবা অর্থনৈতিক ব্যবহারের সক্ষমতা আমাদের এখনো তৈরি হয়নি। যেখানে উন্নত বিশ্বে মাছ ধরার কাজে দুই হাজার টন বা তার বেশি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ফিশিং ভেসেল ব্যবহার করা হয়, সেখানে বাংলাদেশের ফিশিং ভেসেলে সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ৩০০ টন। এক্ষেত্রে আমাদের উন্নত প্রযুক্তির ফিশিং ভেসেল নির্মাণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাছাড়া আমাদের দেশে প্রতি বছর ৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন পণ্য সাগরপথে আসে। কিন্তু নিজেদের জাহাজের অপ্রতুলতার কারণে ৬ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা পণ্য পরিবহনে ব্যয় হয়। তাই জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে আরো এগিয়ে নিতে হবে। বিশ^বাজারে বর্তমানে মাছের বাজার ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। সুতরাং কাজের ক্ষেত্রও অনেক বড়। দেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে বিপুল পরিমাণ মৎস্যসম্পদ আহরণে ডিপ সি ফিশিং ভেসেল এবং লং লাইন শিপ তৈরিতে জোর দিতে হবে।
জাহাজ নির্মাণ শিল্প: সমুদ্রে নিজেদের অবকাঠামোর ঘাটতি কাটিয়ে উঠার জন্য সব থেকে জরুরি জাহাজ নির্মাণ শিল্প গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে স¤প্রতি বাংলাদেশ দ্রæততম সময়ে যথেষ্ট উন্নতি করেছে। অনেকগুলো প্রাইভেট শিপইয়ার্ড গড়ে উঠেছে। ভারতে আমরা ৮০০০ টনের জাহাজ রপ্তানি করেছি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অধিনে খুলনা শিপইয়ার্ড, নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড, চিটাগং ড্রাইডক সহ বেশ কিছু শক্ত অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। পায়রা বন্দর ঘিরে বিশাল শিপইয়ার্ড গড়ে তোমার প্রস্তাব করা হয়েছে। শিপইয়ার্ডের কাজ যে শুধু জাহাজ নির্মাণে সীমাবদ্ধ তা নয়। বর্তমান জাহাজ গুলোর মেরামত রক্ষণাবেক্ষণ, বঙ্গোপসাগর ঘিরে বিদেশি জাহাজের মেরামতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হাব হয়ে ওঠার নিয়ামক হিসাবে কাজ করবে। বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি করে দিবে এটি।
সমুদ্র বন্দর কেন্দ্রিক উন্নয়ন: আমি আমার আগের লেখায় মাতারবাড়ি, সোনাদিয়া, পায়রা নিয়ে আলোচনা করেছি। সে প্রেক্ষিতে অনেক আলোচনা আগেই হয়ে গেছে। এরপরো যে না বললেই নয়, বাংলাদেশের বন্দরকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে গেলে শুধু বাংলাদেশের ব্যবহার নির্ভর হলে চলবে না। বন্দর ব্যবহারকারী হিসাবে অন্যান্য দেশকে সংযুক্ত করতে হবে। বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরকে আন্তর্জাতিক রুটে পরিণত করতে হবে। এক্ষেত্রে ভালো অঙ্কের ট্রানজিট ফি ধার্য করে ভারত, চীন, নেপাল, ভুটানকে জড়াতে হবে। যদি আমরা বার্মা, থাইল্যান্ড হয়ে চীন পর্যন্ত সড়ক সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হই সেক্ষেত্রে সেসব দেশের জন্য বাংলাদেশের বন্দর ব্যাবহারের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ভারতের পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলো হয়ে উঠতে পারে এই বন্দরের অন্যতম ব্যবহারকারী। সেই সঙ্গে ভারতের কাছ থেকে নেপাল এবং ভুটানে ট্রানজিট আদায় করে নিতে হবে। এর ফলে বাংলাদেশের বন্দর ব্যাবহার করে ল্যান্ড লকড এই দেশগুলো উপকৃত হতে পারবে সেই সঙ্গে ট্রানজিট ফি এবং বন্দর ব্যবহার বাবদ বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ যেমন ভারত, চীন, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুর এই গতিশীল ও সমৃদ্ধ যাত্রায় পরস্পরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করবে। এ অভিযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রচুর জাহাজের প্রয়োজন হবে। অবশ্যই বাংলাদেশের শিপইয়ার্ডগুলোর পক্ষে সব ধরনের জাহাজ সরবরাহ সম্ভব নয়। তার পরও আমাদের দক্ষতা ও গুণগত উৎকর্ষের ফলে এ বাজারের সিংহভাগ আমরা দখল করতে পারব এবং আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর ক্রেতাদেরও আকর্ষণ করতে সক্ষম হবো।
সমুদ্রের খনিজ সম্পদ: বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে বিশ্বের সব থেকে বড় মহীসোপানের মালিক। উপক‚ল থেকে এটি কোথাও কোথাও ১৫০-২০০ নটিকাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। আর অগভীর মহীসোপানে তেল গ্যাসের অফুরন্ত মজুদ থাকার সম্ভাবনা বেশি। বার্মা অংশে বৃহৎ গ্যাস খনির সন্ধান বাংলাদেশ অংশেও পাবার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশ আপাতত সমুদ্রে তেল গ্যাস আহরণে যেতে আগ্রহী না। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনায় এটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে দিতে আগ্রহী।
বাংলাদেশ নেভির ভ‚মিকা: সমুদ্র অর্থনীতিরর সুফল যেমন রয়েছে ঠিক তেমনি রয়েছে এই বিশাল সমুদ্রের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবনা। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে নেভিকে শক্তিশালী করে যাচ্ছে। নেভির নেতৃত্বে শিপ বিল্ডিং অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য জোর দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ নেভির সক্ষমতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত জনবল গড়ে তোলা হয়েছে। তার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আলোচনা অনেক বড় হয়ে যাবার জন্য দুঃখিত। অনেক বিষয়ে আলোচনার সুযোগ পায়নি। সবশেষে বলা যায় বাংলাদেশের সফলতা নির্ভর করছে সমুদ্রকে কতটা কার্যকরভাবে ব্যাবহার করে এর থেকে টেকসই উন্নয়ন করতে পারি তার উপর। লেখক: ব্যাংকার