একটি টেকসই ও নিরাপদ পরিবেশের জন্য এআই
ইমরান হোসেন
পরিবেশগত অবনতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জরুরি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য লড়াই করার কারণে এই সমস্যাগুলো মোকাবেলায় বাংলাদেশের অভিনব প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কৌশল গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমানভাবে পরিবেশগত অবক্ষয় দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, যার মধ্যে বায়ু এবং জল দূষণ থেকে শুরু করে বন উজাড় এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেমন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং চরম আবহাওয়ার ফলে ঝুঁকিপূর্ণ স¤প্রদায়গুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা সুস্পষ্ট যে শুধুমাত্র প্রচলিত কৌশল ব্যবহার করে সফলভাবে এই সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য যথেষ্ট হবে না। ফলস্বরূপ এখন এআই-এর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করা এবং উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন কার্যকর করার জন্য তাদের ক্ষমতায় কাজ করা প্রয়োজন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের যে কোন সমস্যার নিষ্পত্তির একটি গ্রাউন্ড ব্রেকিং টুলস। এই শক্তিশালী শক্তি টেকসই উন্নয়ন প্রচার এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পরিবেশ রক্ষা করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আমাদের পরিবেশগত উদ্যোগে এআই অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে আরও টেকসই এবং সবুজ বাংলাদেশ অর্জন করা যেতে পারে। পরিবেশগত অবনতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জরুরী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য দেশটি লড়াই করার কারণে এই সমস্যাগুলো মোকাবেলায় বাংলাদেশ অভিনব, প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কৌশল গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এনভায়রনমেন্টাল মনিটরিং হল এআই এর সবচেয়ে দরকারী অ্যাপ্লিকেশনগুলোর মধ্যে একটি। ডেটা অ্যানালিটিক্স এবং এআই চালিত সেন্সরগুলো সারা দেশে বাতাস এবং জলের গুণমান ক্রমাগত নিরীক্ষণ করতে পারে। কর্তৃপক্ষের দ্রæত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এবং দূষণের উৎসগুলোকে দ্রæত সনাক্ত করার জন্য, এই রিয়েল-টাইম তথ্যগুলো অমূল্য। উচ্চ দূষণের মাত্রা সহ এলাকা খুঁজে বের করা, নির্গমন কমাতে, প্রাকৃতিক বাসস্থান রক্ষা এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য কৌশল বাস্তবায়নের অনুমতি দেয়। জলের গুণমান, ব্যবহারের ধরণ এবং প্রাপ্যতা সহ প্রচুর পরিমাণে ডেটা বিশ্লেষণ করতে এআই নিযুক্ত করা যেতে পারে। এআই চালিত ভবিষ্যদ্বাণীমূলক মডেলিংয়ের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ পানির ঘাটতি এবং দূষণের পূর্বাভাস দিতে পারে, সকলের জন্য বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে সময়মত হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম করবে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য, বাংলাদেশে বায়ু দূষণ প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মৃত্যুর কারন। প্রধান শহর এবং শিল্প এলাকা জুড়ে এআই-চালিত বায়ু গুণমান পর্যবেক্ষণ সিস্টেম স্থাপন করে, আমরা দূষণের মাত্রার রিয়েল-টাইম ডেটা পেতে পারি। এআই অ্যালগরিদম তখন দূষণের এলাকাগুলো সনাক্ত করতে এবং নির্গমন রোধে লক্ষ্যযুক্ত নীতিগুলো বিকাশ করতে ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারে। তাছাড়া এআই চালিত পরিবহন ব্যবস্থাপনায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রন করতে পারে, যানবাহনের চাপ কমাতে পারে এবং শহুরে বায়ুর গুণমান উন্নত করতে পারে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়ে জাতিসংঘের অনুমান উদ্বেগজনক, বর্ধিত তাপমাত্রা, ক্রমবর্ধমান গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন এবং ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পূর্বাভাস দেয়। জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন এবং অভিযোজন প্রচেষ্টায় এআই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে। এআই চালিত জলবায়ুর আরও সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান করতে পারে, যা নীতিনির্ধারকদের জলবায়ু-সম্পর্কিত ঝুঁকি কমাতে কার্যকর কৌশল তৈরি করতে সহায়তা করে। এআই চালিত নির্ভুল কৃষি জল সংরক্ষণ এবং কৃষিজল নির্গমন হ্রাস করার সময় ফসলের ফলনকে পরিচালনা করতে পারে। জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর নির্ভরতা কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সৌর ও বায়ু শক্তির ব্যবহার নবায়নযোগ্য শক্তি একীকরণকে সমর্থন করতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় যে ১১টি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ১৭৯,১৯৮.৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যা সক্রিয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়। এআই দুর্যোগের পূর্বাভাস এবং দুর্যোগপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করার জন্য ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দুর্যোগের প্রস্তুতি এবং প্রতিক্রিয়া প্রচেষ্টা বাড়াতে পারে। এআই দ্বারা চালিত প্রাথমিক সতর্কীকরণ সিস্টেমগুলো সময়মত সতর্কতা প্রদান করতে পারে, তাদের প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে এবং প্রয়োজনে নিরাপদ স্থানে যেতে সক্ষম হয়।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রেক্ষাপটে, এআই বিপন্ন প্রজাতির সুরক্ষা এবং অবৈধ চোরাচালানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করতে পারে। এআই চালিত ক্যামেরা এবং ড্রোন বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং উন্নত মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমগুলো বিপন্ন প্রজাতিকে সঠিকভাবে সনাক্ত ও চিহ্নিত করতে পারে। উপরন্তু এআই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে থেকে চোরাশিকারিদের কার্যক্রম দ্রæত সনাক্ত করতে বিশাল ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ করে আমরা টেকসই উন্নয়নের প্রচার করতে পারি এবং প্রকৃতি ও মানুষের ক্রিয়াকলাপের মধ্যে একটি সুন্দর সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পারি। দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরেকটি বিষয় কারণ কর্তৃপক্ষ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পুনর্ব্যবহার শুধুমাত্র অল্প পরিমাণে সঠিকভাবে নিষ্পত্তি করতে পারে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে আনুমানিক মাথাপিছু বর্জ্য উৎপাদন প্রতিদিন প্রায় ০.৫ কিলোগ্রাম, যার মধ্যে প্রতিদিন মাত্র ০.২ কিলোগ্রাম যথাস্থানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বাকিগুলো স্থানীয়ভাবে নিষ্পত্তি করা হয়, দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে পরিবেশগত সমস্যা তৈরি করে। এআই দক্ষ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেমেও সাহায্য করতে পারে। এআই ডেটা বর্জ্য উৎপাদনের ধরণগুলোর পূর্বাভাস দিয়ে এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য সংগ্রহের পথগুলোকে উৎসাহিত করতে পারে। এই বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে ল্যান্ডফিল বর্জ্য কমাতে পারে। শহর এলাকায়, যানজট এবং কার্বন নির্গমনে পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এআই চালিত স্মার্ট পরিবহন ব্যবস্থা প্রতিশ্রুতিশীল সমাধান প্রদান করে। এআই ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, দক্ষ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট রুটের ধারনা দিতে পারে এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহারকে উৎসাহিত করে গাইডলাইন দিতে পারে, এইভাবে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে এবং বায়ুর গুণমান উন্নত করতে পারে।
শিক্ষা এবং সচেতনতা টেকসই উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে পরিবেশ-বান্ধব অভ্যাস গড়ে তুলতে অও-ভিত্তিক শিক্ষামূলক সরঞ্জাম এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলি তৈরি করা যেতে পারে। বিপুল পরিমাণ ডেটা প্রক্রিয়াকরণ এবং ব্যক্তিগতকৃত সামগ্রী সরবরাহ করার অও এর ক্ষমতার সাথে, এই জাতীয় সরঞ্জামগুলি পরিবেশের প্রতি মনোভাব এবং আচরণ পরিবর্তনের উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। সবশেষে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য এআই গ্রহণের জন্য জনসাধারণ, গবেষণা সংস্থা এবং বেসরকারি খাতের যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। স্বচ্ছতা, গোপনীয়তা এবং ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য এআই বিকাশকে অবশ্যই নৈতিক বিবেচনার দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। আমরা কেবলমাত্র একটি টেকসই বাংলাদেশ তৈরি করতে পারি যা তার প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করে এবং একসাথে কাজ করে এবং এআই এর রূপান্তরমূলক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি ভাল ভবিষ্যত নিশ্চিত করে।
ইমরান হোসেনÑ আইএফইএস এবং ইউকে-এইডএর সাবেক গবেষক। সূত্র : নিউএজ। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ