উদ্বেগ কাটছে না জ্বালানিতে
মেহেদী হাসান মুরাদ : (১) বিশ্বব্যাপি অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কা ,ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ,অন্তর্জাতি রাজনৈতির মেরুকরণ, সর্বপরি বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির সংক্রমণে অর্থনৈতিক ঘাটতির মধ্যে রয়েছে বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশ। বাংলাদেশও তার বাহিরে নয়। স¤প্রতি দেশের বেসরকারি এক সংবাদ মাধ্যম দৈনিক যুগান্তরে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুঈদ রহমান এক প্রতিবেদনে লিখেন, সরকার ২০৩০ এবং এরপর ২০৪১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা হরহামেশাই বলে আসছে। পরিকল্পনার কথা শুধু বলার মাঝেই সীমিত নেই, আছে অনেকখানি আত্মতৃপ্তির আভাসও। আশাবাদী পরিকল্পনার কথা বলা যত সহজ, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা ততটা সহজ নয়।
(২) চলতি মাসের ৬ তারিখে দেশের অর্থনীতি ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে জানাযায় , বিদ্যুৎ, শিল্পসহ অন্যান্য খাতের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে আমদানি করা হচ্ছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), কয়লা ও জ্বালানি তেল। এসব খাতে প্রতি বছর ক্রমবর্ধমান হারে দেশে জ্বালানি চাহিদা বাড়ছে। সরকারের জ্বালানি ব্যয়ের প্রাক্কলন ধরে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় হবে ২৪ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার।
(৩) এ অবস্থায় চলমান ডলার সংকটের প্রেক্ষাপটে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্য হলো সরকার ২০৪১ সাল নাগাদ দেশে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করতে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে গিয়ে বিপাকে পড়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় গ্যাসের অনুসন্ধানে জোর দেয়া হলে এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। পাশাপাশি নিজস্ব কয়লা উত্তোলনেও দ্রæত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
(৪) সরকারের গ্যাসের চাহিদা ও জ্বালানি আমদানিসংক্রান্ত প্রাক্কলন বিষয়ে এফবিসিসিআই সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছর নাগাদ দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে দৈনিক ৫ হাজার ৭৯ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বর্তমান চাহিদার চেয়ে প্রায় ৬ শতাংশ বেশি। দেশে গ্যাসের মজুদ কমে যাওয়ায় এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। তবে বর্তমানে চাহিদা পূরণে কেবল আমদানিনির্ভরতা থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ শুধু জ্বালানি আমদানিতেই ব্যয় হবে ২৪ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার।
(৫) দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে বার্ষিক ৬৫ লাখ টন। এ চাহিদার ৬৩ শতাংশ পরিবহণ খাতে এবং বাকি ৩৭ শতাংশ সেচ, বিদ্যুৎ ও শিল্প খাতে। দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে ২০২৩ সালে ৫৪ লাখ ৬০ হাজার টন জ্বালানি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিভিন্ন দেশ থেকে জি-টু-জি ভিত্তিতে আমদানি করা হবে ৩৮ লাখ ৬০ হাজার টন পরিশোধিত এবং সৌদি আরব ও আবুধাবি থেকে ১৬ লাখ টন অপরিশোধিত তেল। সিদ্ধান্ত মোতাবেক চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রথম ৬ মাসে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ৭ লাখ ৯১ হাজার টন অপরিশোধিত এবং ২৭ লাখ ৯০ হাজার টন পরিশোধিত তেল আমদানি করেছে। আমদানিকৃত জ্বালানির মধ্যে আছে ডিজেল, জেট ফুয়েল, অকটেন ও ফার্নেস অয়েল।
(৬) দেশের জ্বালানি আমদানিরনির্ভরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ী মহল। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার নিয়ে ৫ আগস্ট ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) এক সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারের মূল প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার : বঙ্গবন্ধুর দর্শন। প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভ‚তত্ত¡বিদ অধ্যাপক বদরুল ইমাম। এ কথা ঠিক, চলমান বৈশ্বিক সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জ্বালানি খাত। এ খাতের ব্যবহার নানাবিধ। ফলে মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ হলো জ্বালানি খাতের মূল্যবৃদ্ধি। জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে স্থানীয় উদ্যোক্তারা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়েছে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আমাদের আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। এ বিষয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিনের বক্তব্য হলো, আগামীর বাংলাদেশের যে লক্ষ্য, সেখানে আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে গেলে আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা থাকবে না। এসব আমদানিতে অনেক সময় ডলার সংকট হতে পারে, আবার টাকা দিয়েও অনেক সময় জিনিস পাওয়া যায় না। এজন্য আমরা মনে করি, আমাদের আমদানির পাশাপাশি স্থানীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সবাই গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়টিতেই জোর দিয়েছেন।
(৭) এ পর্যন্ত দেশে যে পরিমাণ ব্যবহারযোগ্য গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে এবং যে পরিমাণে দৈনিক উত্তোলন করা হচ্ছে, তাতে সামনে আর মাত্র ৮ বছর চলা যাবে। তারপর সন্ধানকৃত গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে যাবে। এরপর? উৎকণ্ঠার জায়গাটা এখানেই। ভ‚তত্ত¡বিদরা বলছেন, অনেক জায়গায় গ্যাস রয়েছে। একটি ক‚প খনন করতে ব্যয় হয় ৯ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার। ১০০ ড্রিল করলে ২ বিলিয়ন ডলার। লাভ-খরচ বিবেচনায় ধরা যায় ২০ শতাংশ সফল হলে পুরো টাকাই উঠে আসবে। এ টাকার সংস্থান করতে সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে। রাজনৈতিক অবস্থান যার যা-ই হোক না কেন, অর্থনীতির বিষয়ে আমরা যৌক্তিক ও আত্মনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি সব রাজনৈতিক মহলের কাছেই প্রত্যাশা করি। আমাদের স্বপ্ন দেখিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা কাঙ্ক্ষিত নয়। আমরা মাংস-পোলাওয়ের প্রতিশ্রæতি চাই না, মাছ-ভাতের নিশ্চয়তা চাই। আমরা জৌলুসপূর্ণ বর্তমান চাই না, চাই সাদামাটা নিরাপদ ভবিষ্যৎ। তাই ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে নীতিনির্ধারকরা সচেতন হবেন আশা করি।