মূল্যস্ফীতির নিচে চাপা বর্ধিত মজুরি
সিনথিয়া চিছাম : [১] বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির হার ও মজুরি বৃদ্ধির মধ্যে ক্রমবর্ধমান ফারাক স্বল্প আয়ের ও অদক্ষ শ্রমিকদের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালের জুলাই থেকে দেশে মজুরি প্রবৃদ্ধি ধীরে ধীরে বাড়লেও গত ১৮ মাস ধরে তা মূল্যস্ফীতির হারের নিচে চাপা পড়ে আছে।
[২] বিবিএসের মজুরি হার সূচকে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জুলাইয়ে কম আয়ের ও অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা ওই মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশের তুলনায় ২ দশমিক ১৭ শতাংশ কম।
[৩] জুনেও দেখা যায় একই অবস্থা। সে মাসে কৃষি, শিল্প ও সেবাখাতের ৪৪টি পেশার শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। এটি সে সময় মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় ২ দশমিক ৪২ শতাংশ কম।বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির হার ও মজুরি বৃদ্ধির মধ্যে ক্রমবর্ধমান ফারাক স্বল্প আয়ের ও অদক্ষ শ্রমিকদের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিয়েছে। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কমেছে ক্রয়ক্ষমতা।
[৪] অর্থনীতিবিদ ও জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল লেবার অফিসের কর্মসংস্থানবিষয়ক সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, প্রায় দেড় বছর ধরে শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমছে। তাছাড়া, সা¤প্রতিক মাসগুলোয় মজুরি কমার এই হার দ্রæত বেড়েছে। অথচ একই সময়ে অর্থনীতিতে দেখা গেছে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি। এটি উদ্বেগের বিষয়, বলে মন্তব্য করেন তিনি।
[৫] তিনি আরও বলেন, আয় বণ্টনের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে প্রকৃত মজুরি কমে যাওয়া। তার মতে, মূল্যবৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট দুর্দশা কেবল নি¤œ আয়ের মানুষদেরই নয়, এটি নি¤œ-মধ্যম আয়ের মানুষদের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কম আয়ের মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই এর প্রভাব বিস্তৃত জনগোষ্ঠীর ওপর পড়ছে।
[৬] রিজওয়ানুল ইসলাম মনে করেন, বর্তমান মূল্যস্ফীতির কারণে দেশে তালিকায় নিচের দিক থেকে থাকা ৪০ শতাংশ মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো মাছ, মাংস ও ডিমের মতো কিছু পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কম আয়ের মানুষ এগুলো খাওয়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হতে পারে, উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি মানুষের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ওপর দীর্ঘমেয়াদী বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। যখন শিশু ও তরুণদের ক্ষেত্রে এটি ঘটে, তখন এটি কর্মক্ষম জনসংখ্যার উৎপাদন ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এটি ভবিষ্যতের উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করবে।
[৭] সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, মানুষের প্রকৃত আয় ধারাবাহিকভাবে কমছে। তিনি আরও বলেন, এর অর্থ হচ্ছে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে, মজুরি ছাড়া যাদের আয়ের অন্য উৎস নেই।
[৮] এমন পরিস্থিতির কারণ এই ইঙ্গিত দেয় যে নি¤œ আয়ের মানুষেরা মহামারির ধাক্কা সামলে নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাননি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যখন কোনো দেশ উচ্চতর মূল্যস্ফীতিতে পড়ে, তখন সে দেশের মানুষ তা মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট সুযোগ পান।
[৯] কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত তা দেখি না। নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য কোনো স্বস্তির জায়গা নেই, যোগ করেন সানেম’র নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, আমরা যদি খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিই, তাহলে পরিস্থিতি আসলে আরও খারাপ। তার মতে, মানুষ এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এটি আগের তুলনায় অনেকাংশে বেড়েছে। সুতরাং, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মোকাবিলা নীতি-নির্ধারকদের মূল উদ্বেগ হওয়া উচিত।
[১০] অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, আমরা যদি ভারত, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো যে তারা মূল্যস্ফীতির চাপ ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে পারেনি ২ কারণে। একটি হচ্ছে, অকার্যকর মুদ্রানীতি ও অন্যটি অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা। সূত্র : ডেইলিস্টার বাংলা