এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে বুরো বাংলাদেশের প্রয়াস ফেরদৌস সালাম বিদ্যুত খোশনবীশ
[১] স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি প্রতিটি দেশের প্রত্যেক নাগরিকেরই মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশের সংবিধানে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণভাবে সংযোজিত থাকলেও জনসংখ্যার অনুপাতে স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য কর্মীর অপ্রতুলতা, অর্থনৈতিক অবস্থা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে অপর্যাপ্ত জ্ঞান এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতায়াত ব্যবস্থার প্রতিক‚লতার কারণে দেশের জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
[২] এ ছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারের একার পক্ষে সম্ভব হয় না সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থা কার্যকর করা। এ প্রেক্ষিতে দেশের আরো অনেক এনজিওর মতো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বুরো বাংলাদেশ প্রান্তিক ও গ্রামীণ সাধারণ জনগোষ্ঠীকে মৌলিক স্বাস্থ্য শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং সাশ্রয়ী মূল্যে রোগনির্ণয় ও টেলিমেডিসিন সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে মৌলিক স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে এবং গ্রাম পর্যায়ে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার সেন্টার চালু করেছে। এর ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে অসংখ্য নারী ও কিশোরী মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ পাচ্ছে। এই কর্মসূচির অন্যতম একটি বিষয় হচ্ছে কৈশোরোত্তীর্ণ মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল সময়ের শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি এবং তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য কার্যক্রম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। কারণ, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষেরই বাস গ্রামে। তদুপরি এখন পর্যন্ত গ্রামের অসংখ্য নারী শিক্ষার আলো থেকে বাইরে রয়েছে। অথচ উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দেশে প্রয়োজন স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন নারী সমাজ।
[৩] ফরাসি রাষ্ট্রনায়ক নেপোলিয়ন বোনাপার্টের একটি কথা স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি উন্নত জাতি দেবো। কারণ, তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, শিক্ষিত সচেতন মা মানেই একটি উন্নত চিন্তার পরিবার এবং এই পরিবারগুলো নিয়েই রাষ্ট্র। ঠিক সেই আঙ্গিক থেকেই বুরো বাংলাদেশ গ্রাম পর্যায়ে চালু করেছে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার সেন্টার।
[৫] জামালপুর জেলার প্রান্তিক পর্যায়ের একটি গ্রাম দিগপাইত। এ গ্রামের প্রায় ২৫-৩০ জন কিশোরীর সঙ্গে আমরা কথা বলি। তাদেরই একজন ফারিহা। বয়স ১৩। সে স্থানীয় রহিমা মোজাফফর আইডিয়াল গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। সে জানাল, আমরা গ্রামে বাস করি। আমাদের মায়েরা খুব শিক্ষিত নন। একজন মেয়ে শিশু ধীরে ধীরে বড় হওয়ার মুহূর্তে একটা বয়সে শরীরে ও মনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। সেই পরিবর্তন প্রক্রিয়া উপলব্ধি কারলেও সে সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত কোনো জ্ঞান আমাদের ছিল না। ফলে অনেক মেয়েই
[৬] বয়ঃসন্ধিকালের সময়টিতে লজ্জার মধ্যে পড়ত। লুকিয়ে থাকত। অনেকে এটাকে মারাত্মক কোনো অসুখ মনে করে লজ্জায় নিজের মাকেও বলতে চাইত না। আর মায়েরাও এ ব্যাপারে সন্তানদের সচেতন করার কথা ভাবতেন না।
[৭] অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটি যে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা তা অনেকেরই জানা ছিল না। বুরো বাংলাদেশের মৌলিক স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা গ্রামের কিশোরীসহ আমাদের অভিভাবকরাও সচেতন হচ্ছি। ফারিহা আরও বলল, বুরো বাংলাদেশ কর্তৃক বিনা অর্থে এ ধরনের সহায়তা ও সচেতনতার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
[৮] ১৫ বছর বয়সের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী জেনিকা বলল, বুরো বাংলাদেশের স্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রশিক্ষণ আমার চোখ খুলে দিয়েছে। এই সময়টায় যেকোনো মেয়ের জন্যই হয়ে পড়ে দুর্ভাবনার, দুশ্চিন্তার। অনেক সময় লজ্জায় কারও সঙ্গে শেয়ারও করা হয় না। অনেক মা হয়তো ন্যাকরা (পুরাতন কাপড়) ব্যবহারের পরামর্শ দেন, ঘরে থাকতে বলেন এবং খাবার-দাবারে নানা বিধি-নিষেধ দেন। কিন্তু বাস্তবে এটি দুশ্চিন্তার কোনো বিষয়ই নয়। এই স্বাভাবিক ঘটনার কথাই আমরা জানতে পেরেছি বুরো বাংলাদেশের এই কর্মসূচির মাধ্যমে। আমরা উপকৃত হয়েছি। আমরা যারা বুরো বাংলাদেশ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছি তারা
[৯] প্রত্যেকেই আবার ১০০ বা আরও অধিক নারী ও কিশোরীর সাথে প্রশিক্ষণ থেকেলব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করার চেষ্টা করেছি। এভাবেই আমরা স্কুল এবং আশপাশের কিশোরীদের এ সম্পর্কে সচেতন করেছি। একই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ১৩ বছরের রিয়া মনি জানালো, এমনও পরিবার আছে যারা এ ব্যাপারটিকে কুসংস্কার হিসেবেও দেখত। মেয়েকে ঘরে বন্দি করে রাখত। বলত ঘরের বাইরে গেলে অকল্যাণ হবে। কেউ তার ছায়ায় পা ফেললেও পাপ হবে ইত্যাদি। অজানা ভয় আর আশঙ্কার সৃষ্টি করে দিত। এই আলাপচারিতায় আরো অংশ নেয় ১৩ বছরের জান্নাত, একই বয়সের রুমি, আফরোজা, আলোমনি, জেনিফা, ১৪ বছরের আশাসহ আরও অনেকে।
[১০] ওদের মধ্যে যারা বুরো বাংলাদেশ থেকে সরাসরি প্রশিক্ষণ পেয়েছে তারা
প্রত্যেকেই আবার তাদের আশেপাশের ১০০ জন কিশোরী ও নারীর সাথে প্রশিক্ষণের বিষয়গুলো শেয়ার করেছে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। সপ্তম শ্রেণির আফরোজ বলল, বুরো বাংলাদেশ আমাদের কিশোরীদের কাছে সত্যিকারের আলোর বাতিঘর। তারা প্রত্যেকেই চায় এই কর্মসূচি দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হোক।
[১১] সপ্তম শ্রেণির রুমী সুন্দর করে বলল, ছিলাম অন্ধকার, এখন আছি আলোয়। আর আমরাও নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকেই এ কাজটি করে যাচ্ছি। আমি আমার অনেক সহপাঠীকে এ ব্যাপারে করণীয় কি তা হাতে-কলমে দেখিয়েছি, তাদের মধ্য থেকেও কেউ না কেউ অন্যদের শিখাবে। এভাবেই এই কার্যক্রম বিস্তৃত হচ্ছে।
[১২] দিগপাইত ইউনিয়নের নারায়ণপুর গ্রামে বুরো বাংলাদেশ এর মৌলিক স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত কো হেলথ এডুকেটর মোসাম্মৎ খালেদা খাতুন। তিনি জানান, তিতপল্লা ইউনিয়নের জামতলী গ্রামের ২০০ পরিবারের মধ্যে মৌলিক স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচি পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ১০ জন গর্ভবতী মহিলা তাদের সহায়তায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং সুস্থ সন্তান জন্মদানে সক্ষম হয়েছেন। নিজেরাও সুস্থ রয়েছেন।
[১৪] হেলথ এডুকেটর মোসাম্মৎ চায়না বেগম দিগবাইত ইউনিয়নের ২০০ পরিবারের মধ্যে মৌলিক স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ১৪ জন গর্ভবতী মহিলার দেখভাল করেছেন। তাদের স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সন্তান ভ‚মিষ্ট হয়েছে। কো হেলথ এডুকেটর সালমা বেগম জানালেন, ৪নং ওয়ার্ডে ২০০ পরিবারকে স্বাস্থ্য সচেতন করেছেন। এদের মধ্যে ১৭ জন গর্ভবতী মা। এদের কয়েকজন ইতিমধ্যে সুস্থ ও সুন্দরভাবে সন্তান প্রসব করেছেন। শুরুতে তারা কতজন সন্তান সম্ভবা অর্থাৎ গর্ভবতী তার তালিকা করেন। এরপর তাদের গর্ভবতী অবস্থায় কি ধরনের কাজ করা অনুচিত, কি কি খাওয়া উচিত সেসব বিষয়ে পরামর্শ দেন। আয়রন ট্যাবলেট, শাক সবজি খাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়। প্রসবের পর শিশুর মুখে মায়ের স্তনের শাল দুধ খাওয়ানো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলেও মায়েদের সচেতন করা হয়। কথা বলি দিগবাইত ইউনিয়নের নারায়ণপুর গ্রামের বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে।
[১৫] যারা বুরো বাংলাদেশের মৌলিক স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচির সুযোগ পেয়েছেন। তাদের একজন সীমা। তার সন্তানের বয়স ছয় মাস। তিনি বলেন, এই কর্মসূচির আপারা যেভাবে পরামর্শ দিয়েছে তা মেনে চলায় স্বাভাবিকভাবে সন্তান ভ‚মিষ্ট হয়েছে। গর্ভবতী গৃহবধূ সাথী জানালেন, এই প্রতিষ্ঠানের আপারা প্রায়ই বাড়িতে এসে আমাকে ও পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
[১৬] গৃহবধূ নাসিমা জানালেন, তার ডেলিভারি নরমাল হয়েছে। বাচ্চার বয়স চারমাস। হাসনা বলেন, বুরোর আপারা খুব আন্তরিক। বুরোর স্বাস্থ্য কর্মীরা নিয়মিত তাদের ওজন ও প্রেসার চেকআপ করেন। এ ছাড়া তাদের অনেকেই ১০০ টাকা দিয়ে বুরোর কমিউনিটি হেলথ কেয়ার সেন্টারের হেলথ কার্ড করে নিয়েছেন। এতে তারা বিনা অর্থে এক বছরে ১১টি রোগ নির্ণয়সেবা নেওয়ার সুযোগ পান। বিশেষ করে তারা ব্যয়বহুল বøাড টেস্টগুলো করার সুযোগ গ্রহণ করেন।
[১৭] শুরুতে ২০১৫-১৬ সালে কুড়িগ্রামের ৫টি উপজেলায় ৪৫০০ কিশোরীকে মাসিককালীন স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান করা হয়। এরপর ২০১৯ সালে টাঙ্গাইলে মৌলিক স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচি চালু করা হয়। ইতিমধ্যে সাড়ে ৫ লাখ পরিবার মৌলিক স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং সাড়ে ৪ লাখ পরিবার প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছে। বর্তমানে ১৩টি জেলায় ২ লাখ ৭৬ হাজার পরিবারে এই কর্মসূচি চলমান রয়েছে।
[১৮] উল্লেখ্য, বুরো বাংলাদেশ এর মৌলিক স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচিকে সহায়তা
দিয়ে আসছে অঁংঃৎধষরধহ অরফ এবং ঙঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃু ওহঃবৎহধঃরড়হধষ অঁংঃৎধষরধ। তাদের সহযোগিতার পাশাপাশি বুরো বংলাদেশও এ খাতে নিজস্ব উদ্যোগ গ্রহণ করছে। সংস্থাটির কম্যুনিটি হেলথ কেয়ার সেন্টার ও মৌলিক স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচি দরিদ্রবান্ধব স্বাস্থ্য কর্মসূচি। টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরের আলোকদিয়া কম্যুনিটি হেলথ কেয়ার সেন্টারে প্রতিমাসে গড়ে ৩/৪ হাজার সাধারণ মানুষ সেবা নিয়ে থাকে। এখানে কার্ডধারীর সংখ্যা প্রায় ২০০০।
[১৯] আলোকদিয়া ছাড়াও বুরো বাংলাদেশের এরকম আরো ৫টি কম্যুনিটি হেলথ কেয়ার সেন্টার রয়েছে। তবে আরো বেশি মানুষের মাঝে স্বাস্থ্য শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনেই দেশের প্রতি জেলায় বুরো বাংলাদেশ এর মৌলিক স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচির বিস্তৃতি প্রয়োজন। এই উদ্যোগ নেওয়া হলে নিশ্চিত কওে বলা যায় যে, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনগুলোর কার্যক্রম দেশের স্বাস্থ্য খাতে যুগান্তকারী উন্নয়নের সূচনা ঘটাবে; দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যসম্মত জীবন অর্জন করতে সহায়তা করবে।
লেখক : সম্পাদক, প্রত্যয়, বুরো বাংলাদেশ
বিদ্যুত খোশনবীশ: নির্বাহী সম্পাদক, প্রত্যয়, বুরো বাংলাদেশ