![](https://amaderorthoneeti.com/new/wp-content/themes/amader-orthoneeti/img/sky.jpg)
লিভার রোগের উন্নত ও অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সবরকম সামর্থ্য বাংলাদেশের চিকিৎসকদের আছে : অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল), চেয়ারম্যান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ
![](https://amaderorthoneeti.com/new/wp-content/uploads/2023/08/Mamun-Al-mahtab-400x225.gif)
ভূঁইয়া আশিক রহমান
[২] আমাদের অর্থনীতি : ফ্যাটিলিভার কী? কেন হয়?
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল: শরীরে লিভারের প্রায় পাঁচ থেকে ছয় রকমের কাজ আছে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, শরীরের শক্তি সঞ্চয় করে রাখা। লিভারে চর্বি সঞ্চিত থাকে। এখানে ৫ শতাংশ চর্বিকে আমরা স্বাভাবিক বলে ধরি। যেমন আমরা যখন রোজা রাখছি বা কায়িক পরিশ্রম করছি, তখন আমাদের খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম হয়। কিন্তু তাও আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি না। কারণ লিভারে শক্তিসঞ্চিত থাকে ও সেই সঞ্চিত শক্তি থেকে লিভার শক্তি সরবরাহ করে। কিন্তু লিভারে যদি বেশি চর্বি জমে, তাহলে সেটাকে আমরা রোগ হিসেবে ধরে নিই। তাকে আমরা বলি নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটিলিভার ডিজিজ বা ফ্যাটিলিভার। যাদের ফ্যাটিলিভার থাকে তাদের দুই রকম সমস্যা আছে। যাদের লিভারে চর্বি আছে, কিন্তু কোনো সমস্যা হয় না, তাদের আমরা বলি নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটিলিভারের রোগী। আরেকটি হলো, যাদের লিভারে চর্বি জমার কারণে দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ হয়, এটিকে আমরা বলি ক্রনিক হেপাটাইটিস। যাদের ক্রনিক হেপাটাইটিস আছে, তাদের আমরা বলি ন্যাশ, নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটো হেপাটাইটিস।
[৩] লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সার কখন হয়, কোন পর্যায়ে গেলে? অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : যাদের ন্যাশ থাকে তাদের সবার না হলেও অনেকেরই লিভার সিরোসিস বা পার্মান্যান্ট ড্যামেজ হয়ে যেতে পারে, লিভার ক্যান্সার পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। সেজন্য আমাদের একটি বড় কাজ হলো কাদের ন্যাশ আছে, আর কার নেইÑ সেটি খুঁজে বের করা। কারণ তাদের লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে। যখন ন্যাশ থাকে এবং ন্যাশের কারণে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে, তখন লিভারে ফাইব্রোসিস হতে থাকে। এই ফাইব্রোসিস একটি পর্যায়ে পৌঁছায় যখন স্টেজ-৪ ফাইব্রোসিস হয়ে যায় তখন আমরা বলি লিভারে সিরোসিস হয় গেছে। মূলত সিরোসিস হলে লিভারের ক্ষতি হতে হতে একপর্যায়ে লিভারের আকার-আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়, আকারে ছোট হয়ে যায়, কুঁকড়ে যায় এবং সে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফ্যাটিলিভার আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যাদের ফ্যাটিলিভার থাকে তাদের সাধারণত আরও এক বা একাধিক রোগ থাকতে পারে। আমরা একে বলি বাস্কেট অফ ডিজিজ বা ডিজিজের ঝুড়ি। যাদের ফ্যাটি লিভার আছে তাদের সাধারণত ডায়াবেটিস থাকে। কারণ যাদের ডায়াবেটিস থাকে তাদেরই সাধারণত ফ্যাটিলিভার হয়।
[৪] কাদের চর্বি হতে পারে?
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : যাদের রক্তে চর্বি বেশি থাকে, তাদের লিভারে চর্বি হতে পারে, যাদের হাইপো থাইরয়েডিজম আছে, যাদের ওভারি আছে, যাদের হেপাটাইটিস-সি ভাইরাসে ইনফেকশন আছে, যারা অতিরিক্ত মদ্যপান করেন এসমস্ত লোকের লিভারে চর্বি জমতে পারে। ফলে দেখা যায়, যার হয়তো লিভারে চর্বি আছে, ন্যাশ নেইÑ তার হয়তো হার্টে চর্বি জমে গেছে তখন তার হার্ট অ্যাটাক হতে পারে, ব্রেনে রক্ত জমে স্ট্রোক হয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা শরীরে বেশি চর্বি থাকলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে এবং এটি প্রমাণিত সত্য। যে-সমস্ত মানুষ ফ্যাটিলিভারে আক্রান্ত হন এবং তারা যদি হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসেও আক্রান্ত থাকেন, তাদের থেকে ১৪ শতাংশ ক্ষেত্রে তারা দ্রæত মৃত্যুবরণ করেন। কারণ তারা যে সবসময় ফ্যাটিলিভার জনিত সমস্যায় মারা যাবে তা নয় তারা স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, ক্যান্সারেও মারা যেতে পারেন। ফলে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি কারও ফ্যাটিলিভার থাকে, তাহলে বের করতে হবে তার ন্যাশ আছে কিনা, তার লিভার ক্যান্সার বা লিভার সিরোসিসের ঝুঁকি আছে কিনা এবং একইসঙ্গে তার হার্টে, ব্রেনে কোনো রোগ আছে কিনা থাকলে সেই চিকিৎসা করতে হবে।
[৫] লিভার সিরোসিসের উন্নত চিকিৎসা কি বাংলাদেশে আছে? লিভার চিকিৎসায় বাংলাদেশে সক্ষমতা কতটুকু?
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : লিভার সিরোসিসের যেটি সর্বশেষ চিকিৎসা, যখন লিভার ফেইল করে যায় তখন আমরা বলি লিভার ট্রান্সপ্লন্টেশন করতে হবে। লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে হলে কতগুলো চ্যালেঞ্জ আছে। একজন ডোনার প্রয়োজন আত্মীয়ের মধ্যে অথবা মৃত ব্যক্তির থেকে। আমাদের এদিকে মৃত ব্যাক্তির অর্গান ডোনারের সংখ্যা খুবই কম, আরেকটি বড় সমস্যা হলো প্রচুর টাকা খরচ হয় তার চেয়েও বড় সমস্যা বাংলাদেশে এখনো হচ্ছে না। এটি ভারতে গিয়ে করে আসতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে আমাদের দেশে কয়েকটি ট্রান্সপ্লান্ট করা যাচ্ছে কিন্তু ধারাবাহিকভাবে ট্রান্সপ্লান্ট হওয়ার কোনো চিত্র নেই। আমরা দেখতে পাচ্ছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এবং তার দিকনির্দেশনায় কাজ চলছে।
[৬] আমরা আশা করি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনন্সটিটিউটে বছর খানেকের মধ্যে সফলভাবে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট নিয়মিত হচ্ছে বলে দেখতে পারবো। আমরা যারা লিভার বিশেষজ্ঞ তারা আমাদের জায়গা থেকে কাজ করার চেষ্টা করছি। যারা লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত, তাদের লিভার যাতে ফেইল না করে কিংবা যদি ফেইল করে তাদের লিভার যাতে আবার সুস্থ হয় সেজন্য আমরা স্টেম সেল থেরাপি শুরু করেছি। এটি আমরা বেশ কিছুদিন ধরে করছি। বাংলাদেশে আমাদের লিভার রোগীদের স্টেম সেল থেরাপি দেওয়ার কেস এখন প্রায় ৫০০-র বেশি আছে। আমরা প্রায় ৫০০-র বেশি রোগীকে স্টেম সেল থেরাপি দেওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। সিলেট ও কুমিল্লা মেডিকেলেও এখন স্টেম সেল শুরু হয়েছে।
[৭] স্টেম সেল থেরাপিতে কি লিভার ফেইলিউর রোগী সুস্থ হয়ে উঠে?
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : লিভার ফেইল করে গেছে এমন একজন রোগীকে স্টেম সেল থেরাপী দিলে সে যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে তা নয়। কিন্তু তার লিভার ফাংশন ইম্প্রুভ করে এবং লিভারে ক্ষতির মাত্রা কমে আসে। আর যার লিভার এখনো ফেইল করেনি। কিন্তু লিভার সিরোসিস আছে তাদের ক্ষেত্রে ফেইল হয় না বা বিলম্বিত হয়। আমরা এখন লিভারের প্রেশার মাপতে পারি যাকে আমরা পোর্টাল হাইপারটেনশন বলি। এই পোর্টাল হাইপারটেনশন একটি বড় কারণ লিভার সিরোসিস রোগীদের যদি লিভার ফেইলিউর হয় তাহলে পেটে পানি চলে আসে। আমরা এই কাজটি করি বিএসএমএমইউ-এ এবং যে সমস্ত রোগীদের আমরা পোর্টাল হাইপারটেনশন বেশি পাচ্ছি তাদের ওষুধ দিয়ে প্রেশার কমিয়ে আনছি এতে করেও লিভার ফেইলিউরের ঝুঁকি কমে যাচ্ছে।
[৮] লিভার সিরোসিসের রোগী দীর্ঘদিন সিরোসিসে ভালো থাকতে পারছে। এছাড়া যাদের লিভার ফেইল করছে বা যারা লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে পারে না তাদের জন্যও আমরা কিছু কাজ করছি একটি হলো মুজিব প্রটোকল বা প্লাজমা এক্সচেঞ্জ। এই প্লাজমা এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে আমরা প্রচুর লিভার সিরোসিসের রোগীদের সুস্থ করেছি। এই ব্যাপারে আমাদের বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা আছে। এছাড়া আমরা এখন লিভার ডায়ালাইসিস করি যাদের লিভার ফেইলিউর হয়ে যায় তাদের এই প্রক্রিয়ায় আমরা সুস্থ করতে পারি। এছাড়া আরেক ধরনের রোগী আছে যাদের লিভার ক্যান্সার হয়ে যাবে তাদের জন্য আমরা আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। একটি হলো ইমিউনথেরাপি অর্থাৎ দেশে উৎপাদিত এমন কিছু ওষুধ যেগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় এবং তখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই লিভার ক্যান্সারকে নিয়ন্ত্রণ করে।
[৯] ২০১৮ সালে তাসুকু হনজো নামের একজন জাপানী বিজ্ঞানী ইমিউনো চেক পয়েন্ট ইনহিবিটরস আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। এগুলো মূলত মনোক্লোনাল এন্টিবডি আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধের যে টি-সেলগুলো আছে, লিভার সেল সহ অন্যান্য যে সেলগুলো আছে সেগুলোর সঙ্গে নিজেকে আটকে ফেলে। ফলে টি-সেলগুলো আর ক্যান্সারগুলোকে মারতে পারে না। আর এই ওষুধগুলো যেসব জায়গায় ক্যান্সার সেলগুলো টি-সেলগুলোকে অকার্যকর করে ফেলে সে জায়গাগুলোতে টি-সেগুলোকে কার্যকর করে দেয়। টি-সেল তখন ক্যান্সার সেলগুলোতে মারতে থাকে। এই টি-সেলগুলো বাংলাদেশের বাজারে নিয়ে এসেছে এবং আমরা এগুলো ব্যবহার করছি। এছাড়া চিকিৎসা আছে লিভার ক্যান্সারে বাইরে থেকে আল্ট্রাসনো গাইডেন্সে সুই প্রবেশ করে হিট দিয়ে টিউমারটিকে পুরিয়ে দেয়া হয়।
[১০] হার্টের ডাক্তাররা যেমন হার্টের ভেতর রিং বসায় একইভাবে আমরা লিভারের ভেতর ঢুকে যেখানে যেখানে টিউমার আছে সেখানে সরাসরি লিভারের ভেতর থেকে ভেতরে ওষুধ দিয়ে টিউমারটিকে বøক করে দেওয়া হয়। এই কাজগুলো এখন আমরা করছি বিএসএমএমইউতে। ফলে আমাদের যে চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো আছে তা থেকে আমরা বলতে পারি লিভারে যে সমস্ত চিকিৎসার জন্য রোগীরা দেশের বাইরে যান, এর মধ্যে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট ছাড়া সম্ভবত সব পদ্ধতি এখন বাংলাদেশে আছে। এর স্বীকৃতি স্বরূপ ২০২১ সালের ৭ জুলাই বিএসএমএমইউ তে ইন্টারভেনশন হেপাটোলজি ডিভিশন নামে একটি ডিভিশন চালু হয়েছে।
[১১] দেশে লিভার ট্রান্সপ্লান্টে বাধা কোথায় বলে আপনি মনে করেন
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : মানুষের অসচেতনতা আমাদের জন্য একটি বড় বাঁধা। মানুষ ভাবে, কিডনি দুটো একটি দিলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু লিভার একটি, তাই দিয়ে দিলে সে মারা যাবে। সেক্ষেত্রে তাদের সতর্ক করতে হবে। আরেকটি বড় বাঁধা হলো টেকনিক্যাল বাঁধা। আমাদের দেশে যথেষ্ট দক্ষ জনশক্তি গড়ে ওঠেনি। আমাদের ভালো লিভার সার্জন আছে কিন্তু ট্রান্সপ্লান্ট করার মতো দক্ষ হয়তো দুয়েকজন আছে। আমাদের দেশে ১০০-র বেশি হেপাটোলজিস্ট আছে কিন্তু লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করার মতো দক্ষ হেপাটোলজিস্ট কয়েকজনই আছেন। এটি একটি বিশাল টিম ওয়ার্ক। এই টিম ওয়ার্কে শুধু হেপাটোলজিস্টই নয়, এনেসথেসিস্ট, ল্যাব সাইন্স, নার্স টেকনেশিয়ান সব লাগবে এবং এদের সবাইকে এক হাসপাতালে থাকতে হবে। লিভার ট্রান্সপ্লান্টের জন্য সবচেয়ে আদর্শ জায়গা হলো বিএসএমএমইউ। এখানে ভারতীয়দের সহযোগীতায় একাধিক ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে।
[১২] বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে যে লিভার বিভাগ করা হয়েছে, সেখানে লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মাত্র একজন। কিন্তু একজনের পক্ষে এতো বড় বিভাগ সামলানো সম্ভব নয়, তাই আমরা তিনজন মিলে এখন এটি সামলাচ্ছি। প্রথমত দক্ষ জনশক্তির অভাব এবং দক্ষ জনশক্তি যে এখানে আসবে তার নিশ্চয়তা নেই। হাসপাতালটি নতুন পদ্ধতিতে চালু হচ্ছে বলে সময় লাগছে পুরোপুরি চালু হতে। আমার ধারণা কোনো একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যদি আলোচনা করে এর ম্যানেজমেন্ট প্রক্রিয়া সংস্থাপন করা যেতো, সেক্ষেত্রে এটি আরও তাড়াতাড়ি চালু করা যেতো।
[১৩] বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অনেক লিভার রোগী চলে যান। বিশেষ করে ভারতে। এটা কেন হয়? চিকিৎসকদের প্রতি অনাস্থা, নাকি চিকিৎসক সংকট?
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : দেশে লাখ লাখ লিভার রোগী, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক অনেক কম। লিভার রোগীদের উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার দক্ষতা আমাদের চিকিৎসকদের আছে। অর্থাৎ আমাদের দেশের চিকিৎসকদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও আন্তরিকতা থাকলেও রোগীর সংখ্যা এতো বেশি যে সেই তুলনায় চিকিৎসক খুবই কম। যার ফলে আমরা দেখি, দেশ থেকে বহু লিভার রোগী বিদেশে চিকিৎসার জন্য চলে যান। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে বহু রোগী যান। এটা আমাদের চিকিৎসকদের দোষে নয়, অপর্যাপ্ত চিকিৎসক থাকায় সব রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া যাচ্ছে না। লিভার রোগীর সংখ্যানুপাতে চিকিৎসক তৈরি করতে পারলে লিভার রোগীদের বিদেশমুখিতা কমবে। লিভার রোগের উন্নত চিকিৎসাসেবা বাংলাদেশে আছে। যে সমস্ত লিভার চিকিৎসক বাংলাদেশে আছেন, তাদের পক্ষে উন্নত চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব। আশা করছি, রোগীরা সবসময়ের মতো আমাদের ওপর আস্থা অব্যাহত রাখবেন।
[১৪] হেপাটাইটিস বি-ভাইরাস নিয়ে আমাদের মধ্যে ভুল বা অর্ধ-ধারণা আছে। ফলে অনেক সময় আমরা কঠিন এ রোগটিকে গুরুত্ব দিই না। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন, এতে কার ক্ষতিটা হচ্ছে? জনসচেতনতার অভাব, কার দায় এখানে?
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : হেপাটাইটিস বি হলো একটি রক্তবাহিত ভাইরাস। এই ভাইরাসটি লিভারে ইনফেকশন করতে পারে। দূষিত শরীরের রক্ত যদি সুস্থ শরীরে রক্ত সঞ্চালন কিংবা কাটা ছেড়া, ছুরি-কাঁচির মাধ্যমে প্রবেশ করে। নাক, কান ছিদ্র করা বা দাঁতের ছোটখাটো চিকিৎসা করায় যে যন্ত্রগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলো দূষিত হলে অথবা কিডনি ডায়ালাইসিস বা থেলাসেমিয়ার রোগী বার-বার রক্ত দেয়ার সময় যদি সেই দূষিত রক্ত প্রবেশ করে যায় তখন সে হেপাটাইটিস বি রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়। এই ভাইরাসটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শরীরে কোনো স্থায়ী রোগ করে না কিন্তু কিছু-কিছু ক্ষেত্রে প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে লিভারে দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ করে। এদেরকে আমরা ক্রনিক হেপাটাইটিস এবং ক্রনিক হেপাটাইটিস বি বলি। ক্রনিক হেপাটাইটিস বি যাদের থাকে তাদের অনেকেরই লিভার সিরোসিস, লিভার ডেমেজ বা লিভার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
[১৫] বাংলাদেশের কত শতাংশ মানুষ হেপাটাইটিস বি-ভাইরাসে আক্রান্ত?
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : বাংলাদেশের প্রায় ৫ শতাংশ মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। অর্থাৎ, এদেশের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষের হেপাটাইটিস বি আছে। এটিই এদেশের লিভার সিরোসিস এবং লিভার ক্যান্সারের প্রধানতম কারণ। এই রোগের কোনো লক্ষণ থাকে না বললেই চলে। যাদের ক্রনিক হেপাটাইটিস থাকে তাদের কারো কারো পেটের ডান পাশে ব্যাথা হয় কিন্তু এগুলো কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষণ নয়। ফলে বেশিরভাগ মানুষের এটি শনাক্ত হয় যখন রক্ত দিতে যায় বা টিকা নিতে যায় বিদেশ যাবে বলে। তখন ডাক্তাররা তাদের পরীক্ষা দেয় এবং ডাক্তার বলে তাদের চিকিৎসার দরকার নেই তারা ফলোআপে থাকবে। তাতে করে রোগীদের মধ্যে একটি ভ্রান্ত ধারণা চলে আসে যে তাহলে আর পরীক্ষা করানোর প্রয়োজন নেই।
[১৬] তাছাড়া এর চিকিৎসা হয় দীর্ঘমেয়াদী কখনো কখনো সারা জীবনের জন্য। সেজন্য মানুষ এই চিকিৎসা করতে চায়না। আরেকভাবে এটি শনাক্ত হয়, তা হলো কোনো পরীক্ষা করায়নি কিন্তু হঠাৎ করেই দেখে পেটে পানি চলে এসেছে, রক্ত বমি হচ্ছে, অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে তখন ডাক্তারের কাছে এলে জানতে পারে তারা হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের লিভার নষ্ট হয়ে গেছে, লিভার সিরোসিস আছে, লিভার ক্যান্সার হয়েছে। এরা যখন চিকিৎসা করতে আসে তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। ফলে তাদের ধারণা এই রোগের চিকিৎসা নেই। একধরণের রোগীরা মনে করছে ডাক্তার অযথাই পরীক্ষা দিচ্ছে আর আরেক ধরণের রোগীরা আতঙ্কিত হয়ে যান, তারা মনে করছেন এটি হলে বাঁচার উপায় নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যদি ভাইরাসটি থাকে, এটি যদি শনাক্ত করা যায় এবং যার যেটুকু চিকিৎসার দরকার সেই চিকিৎসায় আনা যায় তাহলে এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এই বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করতে হবে।
[১৭] হেপাটাইটিস বি-ভাইরাসের ওষুধ নিয়ে আপনি কাজ করছেন। এই ওষুধের কী খবর? কবে আসবে বাজারে?
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল: ন্যাসভ্যাক একটি অত্যন্ত ভালো চিকিৎসা পদ্ধতি। এর ফেজ-২ ট্রায়ালে ন্যাসভ্যাক ব্যবহার করে জাপানের অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষের হেপাটাইটিস বি’র এন্টিবডি তৈরি হয়েছে। আর আমরা ন্যাসভ্যাক এর ফেজ-৩ ট্রায়ালের রোগীদের ৫ ব রের মতো ফলোআপ করে দেখেছি তারা ভালো আছেন এবং তাদের লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সার হয়নি। একটি ওষুধ ৬ মাস ব্যবহার করে যদি ৫ বা ১০ বছর নিশ্চিন্ত থাকা যায় তাহলে এটি একটি বিশাল ব্যাপার। ন্যাসভ্যাক বাংলাদেশে আসার অনুমতি পেয়ে গেছে এবং এখন টেকনোলজি ট্রান্সফারের মাধ্যমে বাংলাদেশে উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এখন যেই গতিতে কাজ এগোচ্ছে সেভাবে এগিয়ে গেলেও আগামী বছরের শুরুতে এটি বাজারে চলে আসবে বলে আমরা আশাবাদি।
পরিচিতি : শ্রæতিলিখন: জান্নাতুল ফেরদৌস
![](https://amaderorthoneeti.com/new/wp-content/themes/amader-orthoneeti/img/sky.jpg)