পুঁজিবাদ তার অলক্ষ্যে শোষণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে
আহসান হাবিব
[১] আমাদের দেশের অধিকাংশই রাজনৈতিক দল ইতিহাসের বর্জ্য নিয়ে রাজনীতি করতে ব্যস্ত। ধর্ম হচ্ছে প্রথম বর্জ্য, যা পরিত্যক্ত হয়েছে ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। তারপর থেকে পৃথিবী যতো এগিয়েছে, ধর্মের অলীকতা এবং শোষণের বিষয়টি মানুষ বুঝতে পেরেছে, ততো তাকে ছুঁড়ে ফেলেছে। বিশেষত রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। যে সমস্ত রাষ্ট্র এটা করতে পেরেছে, তারা এগিয়ে গেছে বহুদূর। বিজ্ঞান তাদের উন্নতির প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আর বিজ্ঞান যতো এগিয়েছে, প্রকৃতির রহস্য বলে খ্যাত বিষয় জানা হয়েছে, ধর্ম ততো লেজ গুটিয়েছে।
[২] কিন্তু আমাদের মতো রাষ্ট্রে এটা এখনো টিকে আছে। মুক্তিযুদ্ধ ধর্মের উপর তার বিজয়কেতন উড়িয়েছিল, কিন্তু সেটা বেশিদিন টেকেনি। ধর্ম মানে আমি রাজনৈতিক ধর্মের কথা বলছি। যে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র বানাতে চায়, আমি সেই ধর্মের কথা বলছি। ধর্মের উপর ইহজাগতিকতা জয়লাভ করে পরাজিত হয়েছে কেন? কারণ এখানে মানুষ ধর্মের অলীকতা থেকে বের হতে পারেনি। তারা এটাকে আঁকড়ে বাঁচতে চায়। বিজ্ঞান তাদের কাছে গৃহীত নয়। ফলে মানুষ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যে উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়, তার সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। ধর্ম যেহেতু একটা অনুৎপাদনশীল বিষয়, অন্যের দানের উপর নির্ভর করতে হয়, তাই ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজন কোনো শ্রম ছাড়াই বাঁচতে চায়। যখন এটার ব্যতয় ঘটে, ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে, নৃশংস হয়ে ওঠে।
এই নৃশংসতাকে ভয় পায় আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। নিজেরাও এখান থেকে মুক্ত হতে পারেনি, ফলে ধর্ম তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠে। বিজ্ঞান যেহেতু এখানে বর্জনীয়, তাই খুব সহজেই ধর্মরে নামে রাজনীতি এবং শোষণ করা যায়। একে অতিক্রম করে ইহজাগতিক রাজনীতি করতে যে বুকের পাটা লাগে, তা এদের নেই। ফলে প্রগতিশীল রাজনীতি এখানে অনুপস্থিত।
প্রগতি কথাটি এখানে এখন একটি গালি। অথচ রাজনীতি হওয়া উচিত প্রগতির ভিত্তিতে। কারণ যে উৎপাদন ব্যবস্থা মানুষের স্বতঃস্ফ‚র্ত এবং ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে উদ্ভুত হয় এবং এগিয়ে চলে, প্রগতির ধারণাটি তার সঙ্গে সম্পর্কিত। যা পশ্চাৎপদ, পরিত্যক্ত এবং যুগের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তা প্রগতিবিরোধী। আমরা উন্নতি চাই, কিন্তু প্রগতি চাই না। এই যে সংঘর্ষ, এতে ধর্ম এখানে বিজয়ী। ফলে বস্তুগত উন্নয়ন হলেও মানসিক উন্নয়ন হয় না। পিছিয়ে থাকে। সকলেই থাকে তা নয়, যারা প্রগতিকে ধারণ করে, তাদের সংখ্যা নগণ্য। ফলে এদেশের রাজনীতি এই বর্জ্যকে ঘিরেই আবর্তিত হয়ে চলেছে।
[৩] ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিযুক্ত করতে না পারলে, এই রাষ্ট্র কলুর বলদের মতো একই ঘূর্ণাবর্তে ঘুরতে থাকবে। আর রাজনৈতিক দলগুলো একই ঘাসের জাবর কাটতে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধ সে কাজটি সফলভাবে করেছিল। কিন্তু আগেই বলেছি মুক্তিযুদ্ধ এখানে পরাজিত। যাদের হাতে পরাজিত অর্থাৎ ধর্মান্ধ সা¤প্রদায়িক গোষ্ঠী, তাদেরকে রাজনীতি থেকে বিদেয় করতে না পারলে সত্যিকারের রাজনীতি শুরু হবে না। এখানে একদল আসবে, আর একদল আসবে।
পুঁজিবাদ তার অলক্ষ্যে শোষণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, আর আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ধর্ম নিয়ে কামড়াকামড়ি করছে। যারা আজ কথিত ফ্যাসিবাদের পতন চাইছে, তাদের আরাধ্য আবার আর এক তুমুল ফ্যাসিবাদ। এরা আসলে ফ্যাসিবাদের পতন চাইছে না, চাইছে একটি দলের। অর্থাৎ এই চাওয়া কেবলি ক্ষমতাকেন্দ্রিক। এখানে এই দলগুলো ধর্মের বাতাবরণে ভাড়া খাটতে চায় পুঁজিবাদের। তারা যে টাকা পাচার, দুর্নীতি, বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে, এসব আসলে হিপোক্রেসি। ক্ষমতা হাতে পাওয়াই একমাত্র লক্ষ্য। এসবের মূল কারণ কী? একটাইÑ এরা ইতিহাসের বর্জ্য নিয়ে রাজনীতি করে। লেখক : ঔপন্যাসিক