দাম নিয়ে বিপাকে কৃষক মধুপুরে আনারসের বাম্পার ফলন
কাজী জাকেরুল মওলা, টাঙ্গাইল : [১] মধুপুর গড়ে চলছে রসালো ফলের ভরা মৌসুম। আনারসকে ঘিরে চাষী কৃষক পাইকার মহাজন ও স্থানীয় পরিবহন শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। গড় এলাকার বিভিন্ন হাট বাজার জমে উঠেছে। কাক ডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে আনারস বিকিনিকি। দম ফেলানোর ফুঁসরৎ নেই চাষী পাইকারদের। প্রতিদিন রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে যাচ্ছে এ এলাকার প্রধান অর্থকরী ফসল আনারস। চাষীরা আশায় বুক বাঁধলেও এবার পাচ্ছে না ন্যায্য দাম। গত দশ বছরের মধ্যে এবার আনারসের বাজারে ধস নেমেছে। এ মন্দা বাজারে আনারস চাষীদের গুণতে হচ্ছে লোকসান। পাইকার ফড়িয়ারাও সুবিধা নিতে পাচ্ছে না দাম কমের কারণে। উৎপাদন খরচ তোলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় শেষ নেই চাষীদের।
[২] কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এ বছর মধুপুরে ৬ হাজার ৮শ’ ৪০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এ এলাকায় প্রতি হেক্টর জমিতে আনারসের গড় উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৩৮-৪০ টন। উৎপাদন হবে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৬শ টন। এ বছর গতবারের চেয়ে আনারসের চাষ বেশি হয়েছে। মধুপুরে তিন ধরণের আনারস চাষ হয়ে থাকে। জায়েন্টকিউ, হানিকুইন ও এ বছর বিশ^ বিখ্যাত ফিলিপাইনের সুপার সুইট এমডি-২ জাতের আনারস চাষ হচ্ছে। গড় এলাকার লাল মাটিতে জায়েন্টকিউ বা ক্যালেন্ডার জাতের আনারস সব চেয়ে বেশি চাষ হয়ে থাকে।
[৩] জুলাই-আগস্ট মাস আনারসের ভরা মৌসুম। এ সময়ে গড় এলাকার বাগান বাজারে আনারসের মৌ মৌ গন্ধ। এ এলাকার অর্র্থনীতির চাকা সচল থাকে এ সময়ে। যেন গড় এলাকায় আনারসের নবান্ন উৎসব। এ উৎসবে এ বছর ভাটা পড়েছে। লাভের অংক কৃষকের পকেটে আসছে না। লোকসানের হাতছানি কৃষকের চোখে মুখে। ব্যাংক লোন, সারের দোকান বাকি, শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করতে ধকল পোহাতে হচ্ছে চাষীদের। বিগত দিনের কৃষকের হাসির রেখা অনেকটাই নিভে যাচ্ছে। যেন দুশ্চিন্তা কাটছে না। [৪] সরেজমিনে জলছত্র, মোটের বাজার, গারোবাজার, ইদিলপুর, পিরোজপুর, দোখলা, সাইনামারি ও আউশনারা গিয়ে চাষী, পাইকার, ফড়িয়াদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আনারসের বাজার মন্দার নানা কারণ। বিগত বছরের চেয়ে এ বছর আনারসের চাষ বেশি। বাণিজ্যিক চাষের ফলে অতি মুনাফা লোভীদের থাবায় জৌলুস হারাচ্ছে রসালো ফল আনারস। অপরিপক্ক গাছে অসময়ে আনারস বের করার জন্য অসাধু পন্থা বেছে নিয়েছে বাণিজ্যিক চাষীরা। দেদারছে ব্যবহার করছে নামে বেনামে নানা কোম্পানির কেমিকেল। মাত্রাতিরিক্ত কেমিকেলের ফলে গাছ ও ফলের রাতারাতি ফলনের অসম প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কে কার চেয়ে বেশি বড় আনারস উৎপাদন করতে পারে। বড় ফলে বাজার দখল করার মানসিকতার কারণে গড় এলাকার আনারসের আদিরূপ চেহারা হারিয়ে যাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির ক্ষতি হচ্ছে। কেমিকেল ব্যবহারের ফলে বাধ্য হয়েই বিক্রি করতে হচ্ছে আনারস। বাগানে রাখতে পারছে না পচে গলে নষ্ট হচ্ছে বাগানেই। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কম দামে বিক্রি করছে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে স্থানীয় পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি। বাড়তি শ্রমিক মজুরি। সার কেমিকেলের অতিরিক্ত খরচ। পাইকারদের মোকামে চাহিদা কম। মধ্যস্বত্ত¡ভোগীদের দৌরাত্বসহ নানা কারণে আনারসের চাহিদা দিনদিন কমে গেছে। তবে প্রাকৃতিক ভাবে চাষ করা আনারসের খুচরা চাহিদা ও দাম অনেক বেশি। চাষীরা ভালো দাম পাচ্ছে।
[৫] আনারস চাষী হাবিবুর রহমান বলেন, প্রতিটি আনারসের চারা জমিতে আনা পর্যন্ত হাল চাষ রোপণসহ খরচ হয়েছে ৮-৯ টাকা। এখন বাগান থেকে আনারস কাটতে শ্রমিক মজুরি ১ টাকা। ভ্যান ভাড়া ৫ টাকা। পরিচর্যা খরচ বাদেই প্রতিটি আনারসে খরচ হয়েছে ১৪-১৫ টাকা। ১৮ মাস পরিচর্যার পর আনারস বিক্রির উপযোগি হয়েছে। এ সময় সার, নিড়ানি, পোকামাকড় দমনে রাসায়নিক, রোদে পোড়ার হাত থেকে রক্ষার জন্য খড় দিয়ে ঢেকে দেওয়াসহ দেড় বছরে আরও খরচ হয়েছে প্রতি আনারসে ৭-৮ টাকা। সব মিলিয়ে প্রতিটি আনারসে গড় খরচ পড়েছে ১৮-২২ টাকা। বাজারে আনারস বিক্রি করে খরচ বাদে হাতে পাচ্ছে গড়ে ১৪-১৭ টাকা।
[৬] বানিয়াবাড়ি গ্রামের কলেজ শিক্ষক লিয়াকত হোসেন বলেন, স্থানীয় এক কৃষকের কাছে আমার দেড় একর জমি আনারস চাষের জন্য বর্গা দিয়েছিলেন। ২৩ হাজার জলডুগি আনারস খরচ বাদে ৮ টাকা হারে দাম পেয়েছিলাম।
[৭] গারো বাজারের সাজ্জাদ রহমান বলেন, গত বছর যে আনারস ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, চাহিদা কম থাকায় এ বছর ৩০-৩৫ টাকার বেশি দিয়ে নিতে চাচ্ছে না পাইকাররা।
[৮] কুষ্টিয়ার আড়ৎদার শাহজাহান আলী বলেন, এবার আনারসের চাহিদা কম। অন্যান্য বছর সকালে ট্রাক থেকে আনারস আড়তে নামালে খরিদ্দার ভীড় জমাতো। এখন ভীড়ও কম, দামও কম। যে আনারস অন্য সব বছর ৬০-৭০ টাকা বিক্রি হয়। এ বছর হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা।
[৯] আশ্রা গ্রামের আনারস চাষি সোহেল রানা বলেন, আনারস বড় ও পাকাতে বিভিন্ন কোম্পানির রাসায়নিক ব্যবহার করেছে অনেক কৃষক। গ্রোথ হরমোন ব্যবহারে আনারসের আকার বড় হলেও ভেতরে ফাঁপা ও পানসে হয়ে যায়। অধিক লাভের জন্য বড় করার আশায় কৃষক মাত্রাতিরিক্ত হরমোন ব্যবহার করার ফলে এমন অবস্থা। পাকানোর জন্য রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে কয়েক দিনের মধ্যে আনারস হলুদ রং হয়ে যায়। কিন্তু যদি রাসায়নিক না দেয়া হয় তাহলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অল্প সংখ্যক আনারস পাকে যার ফলে এক সাথে বিক্রি করা যায়না। কৃষকরা টাকাও ঘরে আনতে পারেনা ঠিক ঠাকমত।
[১০] বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক প্রাপ্ত কৃষক ছানোয়ার হোসেন বলেন, চাষীদের মধ্যে দেশপ্রেম সৃষ্টি হলেই নিরাপদ আনারস চাষ করা সম্ভব। রাসায়নিক মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োগে ফসলের তেমন ক্ষতি হয় না। কৃষকরা মনমর্জি রাসায়নিক প্রয়োগ ও অপপ্রচারে আনারসের বেশি ক্ষতি হচ্ছে।
[১১] মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল জানান, এবছর মধুপুরে ৬ হাজার ৮শ’ ৪০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এ এলাকায় প্রতি হেক্টর জমিতে আনারসের গড় উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৩৮-৪০ টন। এ বছর গতবারের চেয়ে আনারসের চাষ বেশি হয়েছে। মধুপুরে তিন ধরণের আনারস চাষ হয়ে থাকে। গড় এলাকার লাল মাটিতে জায়েন্টকিউ বা ক্যালেন্ডার জাতের আনারস সব চেয়ে বেশি চাষ হয়ে থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকার কারণে এ এলাকার আনারস সারাদেশে সমাগম ঘটে থাকে। নিরাপদ আনারস চাষের উপর কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ নানা ধরণের পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হয়ে থাকে।
[১২] তিনি আরো বলেন, মধুপুর গড়ের আনারসের ঐতিহ্য ফিরাতে হলে চাষী কৃষক পাইকারসহ সংশ্লিষ্টদের সচেতন হতে হবে। ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার রোধে সকল কে এগিয়ে আসতে হবে। এতে কমে আসবে ঊৎপাদন খরচ।