জার্মান এনার্জি বনাম বাংলাদেশের এনার্জি অবকাঠামো
মাহবুব সুমন
জার্মানিতে পারমাণবিক শক্তি বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন ৬০ এর দশক থেকে। সেই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জার্মান সরকার পারমাণবিক বিদ্যুৎ থেকে সরে আসে। তাদের কয়লার কিছু রিজার্ভ আছে। রাশান গ্যাস, নিজেদের কয়লা আর নব্বইয়ের দশকে নবায়নযোগ্য শক্তিকে এর সাথে যুক্ত করে জার্মানির এনার্জি ব্যাকবোন তৈরি করা। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গ্যাস সংকটে পড়লেও তাদের ট্র্যাক এখনো ওইটাই আছে। পারমাণবিক বিদ্যুতে তারা আর ফেরত যাবেনা।
নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে গত বছর তাদের এনার্জি উৎপাদনের পরিমাণ ২৫৪ গিগাওয়াট আওয়ার। যা তাদের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ৪৬.২০ শতাংশ। গত কয়েক বছর ধরে বেড়ে এখন বাংলাদেশের বিদ্যুতের চাহিদা হয়েছে ৮৫ গিগাওয়াট আওয়ার। দুইটা তথ্য একই সাথে দিলাম, কারন তুলনার ব্যাপার আছে। সামনের বছরগুলোতে জার্মানির নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই পরিমাণ আরো বাড়বে। কারন জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্ব দিয়ে কয়লা থেকেও তারা বের হয়ে যাচ্ছে। সিও২ নির্গমন কমানোর জন্য যে প্রতিশ্রæতি তারা দিয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। জার্মান জাতী বলে কথা।
যারা জার্মানি গেছেন, থাকেন তারা সবাই জানেন যে জার্মান রাষ্ট্র বাংলাদেশের চেয়ে টাকায় অনেক ধনী। কিন্তু প্রাকৃতিক রিসোর্সে না। ভৌগলিক আয়তনে জার্মানি বাংলাদেশের আড়াই গুন। মানুষ ৮ কোটি। নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে তাদের অন্যতম শক্তির জায়গাটা হল তারা তাদের ব্যবহার উপযোগী রুফটপ গুলো থেকে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। সেই বিদ্যুৎ যদি ভবনের কাজে না লাগে তবে সেটা ন্যাশনাল গ্রিডে চলে যায়। এর জন্য প্রয়োজনীয় পলিসি, আইন, ফাইনান্সিয়াল মডেল, ঋণ সুবিধা, ইন্সেন্টিভ, সাবসিডি সব দিয়েছে তারা। আমাদের পলিসি বাদে আর কিছু নাই।
অথচ বাংলাদেশে রুফটফের পরিমাণ জার্মানির চেয়ে অনেক বেশী, সূর্যের আলোর পরিমাণও জার্মানির চেয়ে তিনগুন থাকার পরও সোলার প্যানেল দিয়ে আমরা কিছুই করতে পারলাম না। বড় যেসব সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প হচ্ছে বা ইতিমধ্যে কমিশন করা হয়েছে তার অনেকগুলাই ভিজিট করে দেখলাম সব কৃষিজমি মারা প্রোজেক্ট। আমরা শুরু থেকেই বলে এসেছি নবায়নযোগ্য শক্তিকে গতানুগতিক জীবাশ্ম জ্বালানী ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতন করে ডিল করলে হবেনা। এক জায়গায় বিরাট সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট করে ফেলে পত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প বলে প্রচার করার কিছু নাই। ছোট ছোট করে সারা দেশে প্রচুর করা যেত। রুফটপগুলোকে কার্যকর উপায়ে ব্যবহার করেও বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত গ্রিডে সরবরাহ করা যেত। অন্তত এই ৫ ঘন্টায় তেল, কয়লা, গ্যাস, এলএনজি পোড়ানো লাগতনা। তাতে করেই জাতীয় গ্রিডের চাহিদার ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে চলে আসত কোন ধরণের ব্যাটারি ব্যাকআপ ছাড়াই।
কিন্তু আমরা দেখলাম বাসা বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগের শর্ত হসেবে ছাদে মোট লোডের ৩ শতাংশ মাত্র সোলার প্যানেল লাগানোর একটা শর্ত দেয়া হল। যে শর্তকে কেন্দ্র করে মানুষ আজেবাজে সোলার প্যানেল লাগিয়ে ছাদ ভরল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলনা। এটাকে নিয়ে দুর্নীতি হল, লাইনম্যান, সিভিল কন্ট্রাক্টররা হয়ে গেল পাকা সোলার ইঞ্জিনিয়ার। তারাই এসব লাগায়। যেগুলা মাস খানেক পর আর কাজ করেনা। কিন্তু যদি এই শর্ত হত ২০ শতাংশের তবে মানুষ কাজটা সিরিয়াসলি করত। এটাকে বাড়াতে হবে।
নেট মিটারিং পলিসি একটা আছে। তবে সেই পলিসিকে সাপোর্ট করার মত ফাইনান্সিয়াল মডেল, ঋণ সুবিধা, সাবসিডি, ইন্সেন্টিভ, দেশে উন্নত মানের সোলার প্যানেল, ইনভার্টার, ব্যাটারি, চার্জ কন্ট্রোলার তৈরির করার কোন ব্যবস্থা করা হলনা। ফলে নেট মিটারিং পলিসিও কাজ করছেনা। এটাকে কার্যকর করতে হলে যেগুলা উল্লেখ করলাম তার সব আজ হোক কাল হোক হাজির করা লাগবেই। আমাদের এনার্জি সিকুরিটির জন্যই এসব দরকার।
সেচ কাজে সোলার ইরিগেশানের ব্যবস্থা করা হল। এতে সেচে গ্রিড ও ডিজেল নির্ভরশীলতা কমলেও সৌর বিদ্যুতের প্রচুর অপচয় হল। ওখানেও প্রচুর বাজে প্যানেল ও ইনভার্টারের ছড়াছড়ি। যেগুলা ভাল আছে সেগুলা থেকে সারা বছরতো সেচের বিদ্যুৎ লাগেনা। ফলে যে সময় সেচে বিদ্যুতের চাহিদা নেই, সেই সময় সেই বিদ্যুৎ গ্রিডে নিয়ে আসা যেতে পারে। ফলে সেচ সোলার গুলোই ভাল গ্রিড ব্যাকআপ হতে পারে।
উন্নত মানের ব্যাটারি এসেম্বলিং ফ্যাক্টরি করা, বিদেশ থেকে ব্যাটারি ক্রয়ে আমদানি শুল্ক কমানোর ব্যবস্থাও করতে হবে। সাথে বায়ু বিদ্যুৎ ভিত্তিক শক্তিশালী একটা বিদ্যুৎ নেটওয়ার্ক তৈরি করলে আমাদের এনার্জি সিকিউরিটি অনেক বেড়ে যাবে।
শুরুর দ্বিতীয় প্যারাতে লিখেছিলাম- জার্মানির প্রাকৃতিক রিসোর্স তেমন না থাকলেও তাদের সবচেয়ে বড় রিসোর্স হল -নবায়নযোগ্য শক্তি বাস্তবায়নে তাদের পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট, সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা- এগুলা। এখানেই আমরা পিছিয়ে আছি। এই গ্যাপগুলো পূরণ করা গেলে- বলা যায়না আমরা জার্মানির সাথেও অর্থনৈতিকভাবে টেক্কা দিতে পারব। সেই সক্ষমতা, ও প্রাকৃতিক সুবিধা আমাদের আছে।
ছবিতে জার্মানির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত একটা বাংকারকে তারা বিভিন্ন রকম (সৌর, বায়োমাস) নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের হাব হিসেবে ডেভলাপ করেছে। এই বাংকার থেকে যে পরিমাণ (৩৭৫০ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় তা দিয়ে ৪ হাজার বাসা চলে। সেটাই দেখতে যাওয়া। সাথে আনু স্যার। ওই হাবের ম্যানেজার আমাদেরকে পুরো প্ল্যান্ট ঘুরিয়ে দেখাল। ওইটা দেখে আসার পর আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। কারন এত কম সূর্যের আলো নিয়ে জার্মানি যা করে দেখাল- আমরা তার চেয়ে বহুগুন বেশী দেখাতে পারতাম। জার্মানি যদি ২৫৪ গিগাওয়াট এনার্জি নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে উৎপাদন করতে পারে, আমরা কম করে হলেও ৪০০ গিগাওয়াট আওয়ার এনার্জি- সৌর, বর্জ্য ও বায়ু বিদ্যুৎ থেকে উৎপাদন করতে পারি।
আমার এই প্রেডিকশান গুলোর পেছনে প্রমাণিত গাণিতিক হিসাব আছে। তবে অতীতকাল থেকেই দেখেছি কতিপয় অতিবুদ্ধিমান আমার দেয়া হিসাব, গনিত নিয়ে হাসাহাসি করেন। কি লাভ হয়েছে তাতে! আমার গনিত নিয়ে হাসাহাসি করে ফসিল ফুয়েলকে জয়ী করেছেন তারা।