ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় নিরবচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ বড় চ্যালেঞ্জ : বিদ্যুৎ বিভাগ
সোহেল রহমান : [১] অভ্যন্তরীণ সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে যথোপযোগী প্রাথমিক জ¦ালানি নির্ধারণ বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম প্রধান সমস্যা। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জীবাশ্ম জ¦ালানির ওপর নির্ভরশীলতা অনস্বীকার্য। প্রাকৃতিক গ্যাসের অপ্রতুলতা, আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি-নির্ভর জ¦ালানি মূল্যের অস্থিরতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারসহ নানা কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এমতাবস্থায়, মানসম্পন্ন, নিরবচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ বৃহৎ চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
[২] পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতে সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চাহিদা অনুযায়ী অর্থায়ন অর্থাৎ দেশি-বিদেশী বড় অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিদ্যুৎ বিভাগ-এর পরিকল্পনা মতে, ২০৩০ সাল ও ২০৪১ সাল নাগাদ দেশে যথাক্রমে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিদ্যুৎ খাতে ২০৪১ সালের মধ্যে ৮ হাজার ৫০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন।
[৩] দেশে লোডশেডিংজনিত সমস্যা দূর না হলেও বিদ্যুৎ বিভাগ-এর দাবি অনুযায়ী, দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। গত মে মাসের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় ২৭ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ পাওয়ার ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ) বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার দাঁড়িয়েছে ৬০৮ কিলোওয়াট/ঘন্টা। গত ১৩ বছরে সিস্টেম লস কমেছে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
[৪] বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি সাশ্রয়ী ও মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ২ হাজার ৩৪৮ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন ও প্রায় ৬৩ হাজার ৭০০ কিলোটার বিতরণ লাইন নির্মাণ এবং নতুন ৭৭ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে।
[৫] বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমশ: কমে যাচ্ছে। গত দশ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার প্রায় ১৭ শতাংশ কমেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার ছিল প্রায় ৮৯ শতাংশ। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এটি কমে ৬৮ দশমিক ৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তরল জ্বালানির ব্যবহারও কমেছে। গত ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তরল জ্বালানির ব্যবহার ছিল ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। পরবর্তীতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এর ব্যবহার বেড়ে দাঁড়ায় ২১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছরে তরল জ্বালানির ব্যবহার কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ০৭ শতাংশ।
[৬] সূত্রমতে, তরল জ্বালানির শতভাগ বিদেশ থেকে আমদানির কারণে প্রতি বছর এ খাতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। এমতাবস্থায়, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস/এলএনজি ও কয়লাকে প্রধান জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি বিবেচনা করছে সরকার। তবে এক্ষেত্রে এলএনজি ও কয়লা আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণও একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
[৭] এদিকে পরিবেশগত কারণে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরে আসার বিষয়টিও সরকারের বিবেচনায় রয়েছে বলে জানা গেছে। এ প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে নবায়নযোগ্য জ¦ালানি ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার ৮ শতাংশে উন্নীত করতে চায় বিদ্যুৎ বিভাগ।
[৮] চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিভাগ-এর গৃহীত পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছেÑ সরকারি-বেসরকারি খাতে নতুন ২ হাজার ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সংযোজন; নবায়নযোগ্য জ¦ালানি ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার ৮ শতাংশে উন্নীতকরণ; মাথাপিছু বিদ্যুতের উৎপাদন ৬১০ কিলোওয়াট/ঘন্টায় উন্নীতকরণ; নিরবচ্ছিন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে ৪০ শতাংশ ফিডারে এসএআইডিআই পরিমাপের জন্য স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু; ৫ হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন নির্মাণ ও সাড়ে ৭ হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন আপগ্রেড করা; ৭০০ সার্কিট কিলোমিটার নতুন সঞ্চালন লাইন নির্মাণ; রামপালে মৈত্রী বিদ্যুৎ প্রকল্পের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করা ইত্যাদি।