শেষ বয়সে অর্থনৈতিক লাঠির ভ‚মিকায় থাকবে সর্বজনীন পেনশন
মিজানুর রহমান
২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বাজেট বক্তিতায় অর্থমন্ত্রী সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের ধারনা দিয়েছিলেন। জাতীয় সংসদে সর্বজনীন পেনশন স্কিম ব্যবস্থাপনা ২০২৩ পাশ হয়েছে। সরকারের প্রতিশ্রæতি মোতাবেক ২০২৩-২০২৪ অর্থবছর থেকেই বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হলো।
এক ব্যক্তি তার জীবনের শেষ সময়ে শক্ত অর্থনৈতিক লাঠির ভ‚মিকায় পাশে পাবে এই পেনশনকে। যখন তার সব আয় বন্ধ হয়ে যাবে, তখন সে এই লাঠিতে ভর করে বুক উচিয়ে সমাজে চলতে পারবে। কারও কাছে অর্থের জন্য হাত পাততে হবে না। যেতে হবে না বৃদ্ধিশ্রমের মতো জায়গায়।
স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হলে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী একজন সুবিধাভোগী নূন্যতম ১০বছর চাঁদা প্রদান সাপেক্ষে পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পূর্বে মৃত্যুবরন করলে পেনশনারের নমিনী পেনশনারের ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার অবশিস্ট সময় পর্যন্ত পেনশন প্রাপ্য হবেন। যদি সুবিধাভোগী ৬০ বছর থেকে ৭৫ বছরের উর্ধে বেঁচে থাকেন আজীবন পেনশন পাবেন। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০বছর চাঁদা প্রদান করার পূর্বেই মৃত্যবরন করলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ ফেরত দেয়া হবে। চাঁদা প্রদানকারী কোন আর্থিক সমস্যায় তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ হিসেবে উত্তোলন করা যাবে। পেনশনের জন্য নীর্ধারিত চাঁদা বিনীয়োগ হিসেবে গন্য হবে। এর বিপরীতে কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া যাবে। এছাড়া মাসিক প্রাপ্ত পেনশনের টাকা আয়কর মুক্ত থাকবে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার প্রবর্তন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
সর্বজনীন পেনসন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে হলে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সি সব নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ওয়েবসাইটে গিয়ে নীবন্ধন করতে হবে। যেসব প্রবাসীদের বাংলাদেশের এনআইডি কার্ড নেই তারা বৈধ পাসপোর্ট এর ভিত্তিতে ব্যাংকিং চ্যানেল অনুমোদিত মোবাইল আর্থিক পরিসেবা এক্সচেঞ্জ হাউজের মাধ্যমে বৈদেশিক মূদ্রায় চাঁদা দিয়ে কর্মসূচীতে যুক্ত হতে পারেন। নীবন্ধনের পর একটি নাম্বার পাওয়া যাবে যা চাঁদা পরিশোধের কাজে লাগানো যাবে। গ্রামীণ পর্যায়ে ইউনীয়ন ডিজিটাল সেন্টার সহযোগিতা করবে। এ কার্যক্রমকে সহজ করতে শিগগিরই মোবাইল অ্যাপস চালু করবে পেনশন কতৃপক্ষ।
বর্তমানে চালুকৃত চারটি স্কিম: সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আপাতত চার ধরনের স্কিম চালু করা হয়েছে যেমন- প্রগতি পেনশন স্কিম-যা বেসরকারী চাকুরিজীবীদের জন্য, প্রবাসী পেনশন স্কিম- যা প্রবাসীদের জন্য করা হয়েছে, সুরক্ষা পেনশন স্কিম স্বকর্মসংস্থানে নীয়োজিতদের, সমতা পেনশন স্কিম – নী¤œ আয়ের মানুষ যেমন রিকশা ওয়ালা, কুলি, মজুর, মেথর ইত্যাদি। তাছাড়া সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য আরও ২টি পেনশন কর্মসূচী চালু করার সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে।
সর্বজননীন বিভিন্ন পেনশন স্কিম এর চাঁদার হার নী¤œরূপ- (ক) প্রগতি পেনশন স্কিম এর মাসিক চাঁদার হার হলো ২ হাজার, ৩ হাজার ও ৫ হাজার টাকা। (খ) প্রবাসী পেনশন স্কিম এর চাঁদা ৭ হাজার, ৭ হাজার ৫০০ ও ১০ হাজার টাকা করে। (গ) সুরক্ষা পেনশন স্কিম এর চাঁদা হলো ২ হাজার, ৩ হাজার ও ৫ হাজার টাকা। (ঘ) সমতা পেনশন স্কিম চাঁদা হলো ৫০০ টাকা তার বিপরীতে প্রতিমাসে সরকার দিবে ৫০০ টাকা।
চাঁদা প্রদানের পরিপেক্ষিতে সুবিধা কিভাবে পাওয়া যাবে: প্রগতি পেনশন স্কিম এ প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে ৪২ বছর (১৮-৬০ বছর পর্যন্ত) চাঁদা দিলে প্রতিমাসে পেনশন পাবে ৬৮ হাজার ৯৩১ টাকা। প্রবাসী পেনশন স্কিমের বেলায় প্রতি ৫ হাজার টাকা করে ৪২ বছর দিলে মেয়াদান্তে মিলবে ১ লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা প্রতি মাসে। সুরক্ষা পেনশন স্কিম এ প্রতিমাসে চাঁদা ১ হাজার টাকায় ৬০ বছর পর মিলবে ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা। সমতা পেনশন স্কিম (দারিদ্র্য সীমার নীচে জনগোষ্ঠীর) প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে জমা করলে ৪২ বছর (১৮-৬০) শেষে প্রতি মাসে পাবে ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা।
দেশে সামজিক নীরাপত্তার আওতায় ১ কোটি ৩৪ লাখ জনগোষ্ঠী এই পেনশনের আওতায় আসতে পারবে না। তবে সামাজিক নীরাপত্তার আওতায় সুবিধা ভোগ ত্যাগ করার লিখিত দেয়া হলে সংযুক্ত হতে পারবে। দেশের চার শ্রেণির পেনশন ১০ কোটি মানুষের কথা বিবেচনা রেখে চালু করা হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন স্কিম। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালে ৬০ বছরের বেশী বয়সের মানুষের সংখ্যা হল ১ কোটি ২০ লাখ এবং ২০৪১ সালে এর সংখ্যা হবে ৩ কোটি ১০ লাখ।
এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে টেকসই ও সুসংগঠিত সামজিক নীরাপত্তার কাঠামোর আওতায় আনতে এবং নী¤œ আয় ও অপ্রতিষ্ঠানীক খাতে নীয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষের সুরক্ষা দেওয়ার তৈরি করতে দেশে প্রথমবারের মত পেনশন স্কিম চালু সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বৃদ্ধ বয়সে অনেক ক্ষেত্রে বাবা মা সন্তানদের অনুগ্রহের পাত্র হয়ে থাকতে হয়। এখন আর নীরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হবে না। সর্বজনীন পেনশন স্কিম কর্মসূচী চালু সরকার অভিনন্দন পাওয়ারযোগ্য।
এটি চালু হওয়ায় সরকারের অর্থায়ানের একটি সুযোগ সৃষ্টি হলো। এখন একটি ভালো তহবিল তৈরি হবে। এ তহবিল থেকে সরকার মুনাফা অর্জন না করতে পারা এবং তহবিল ব্যবস্থাপনায় যদি সমস্যা হয় তাহলে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাবে। এ কর্মসূচী অবশ্যই দেশব্যাপী জনপ্রিয় হবে। যদি বাস্তবায়ন করা যায় দেশের নাগরিকদের জন্য সূফল বয়ে আনবে। সামজিক নীরাপত্তা অনেকটা বেড়ে যাবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর প্রথম তিনদিনেই প্রায় ৪০ হাজার আবেদনকারী অনলাইনের মাধ্যমে নিবন্ধন করেছেন। তাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে চার হাজার আবেদনকারী চাঁদা পরিশোধ করে আবেদনের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা ব্যক্তিদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই কোটি টাকার বেশি। লেখক : কলামিস্ট ও ব্যাংকার