ব্যাংক লুটপাটের গল্পগুলো অর্থমন্ত্রীই বললেন!
আব্দুল্লা কাফী রতন
২২ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঋণখেলাপীদের তালিকা উপস্থাপন করেছেন। অর্থমন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৯০ জন ঋণগ্রহিতার কাছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পাওনা ১ লাখ ২ হাজার ৩১৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এদের মধ্যে শীর্ষ ৩০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৭০ হাজার ৫৭১ কোটি। খেলাপি রয়েছে ৫০ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। শ্রেণিকৃত ঋণ ৫২ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। ২০০৯ সাল থেকে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির কাছ থেকে পাঁচ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে এমন ১৪ হাজার ৬১৭ ঋণগ্রহিতার পূর্ণাঙ্গ তথ্যও দিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশান ব্যুরো (সিআইবি) ব্যাংকগুলো থেকে তথ্য নিয়ে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিং সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে। সিআইবির তথ্য ভাÐার থেকে প্রাপ্ত তথ্যই অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন। সেই তথ্যনুযায়ি ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০ ঋণ খেলাপিরা হচ্ছে- চট্টগ্রামের সামানাজ সুপার অয়েল (১ হাজার ৪৯ কোটি টাকা), গাজীপুরের গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডায়িং (৯৮৪ কোটি), ঢাকা সাভারের রিমেক্স ফুটওয়্যার (৯৭৬ কোটি), ঢাকার কোয়ান্টাম পাওয়ার সিস্টেম (৮২৮ কোটি), চট্টগ্রামের মাহিন এন্টারপ্রাইজ (৮২৫ কোটি), ঢাকার রূপালী কম্পোজিট (৭৯৮ কোটি), ঢাকার ক্রিসেন্ট লেদার ওয়্যার (৭৭৬ কোটি), চট্টগ্রামের এস এ অয়েল রিফাইনারি (৭০৭ কোটি), গাজীপুরের সুপ্রভ কম্পোজিট নিট (৬১০ কোটি), গ্রামীণ শক্তি (৬০১ কোটি)।
অর্থমন্ত্রী সংসদকে আরো জানান, রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকসমূহ কর্তৃক ২০১৮ সালে অনুমোদিত মোট সুদ মওকুফের পরিমাণ ১ হাজার ১৯৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা। অর্থমন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যানুযায়ি বেসিক ব্যাংক ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, জনতা ব্যাংক ৫৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা, রূপালী ব্যাংক ১৩৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা, সোনালী ব্যাংক ৭৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, কৃষি ব্যাংক ৪৩৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা সুদ মওকুফ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকসমূহ তাদের গ্রাহকের ৬ হাজার ১৬৩টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে মোট ১ হাজার ১৯৮ কোটি ২৪ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করেছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় ২০০৯ সালের শুরুতে দেশের ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের মার্চে তা হয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে অবলোপনকৃত ঋণ যোগ করলে খেলাপি ঋণ দাঁড়াবে দেড় লাখ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ শাসন আমলে গত দশ বছর তিন মাসে খেলাপী ঋণ চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থমন্ত্রী নিজে সংসদে দাঁড়িয়ে স্বীকার করেছেন শুধু গত ৩৯ মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৪৩ হাজার ২১০ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এ সময়ে ঋণ খেলাপির সংখ্যা বেড়েছে ৫৮ হাজার ৪৩৬ জন।
অর্থমন্ত্রী সংসদে যে ৩০০ ঋণখেলাপী প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করেছেন তাদের মধ্যে অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের নাম না থাকায় ওয়াকেবহাল মহল বিস্মিত হয়েছেন। এর কারণ হচ্ছে সে সব প্রতিষ্ঠানসমূহের অনেকে রিট করে আদলতের আদেশে তালিকায় নেই। আবার অনেকে পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন করে তালিকার বাইরে রয়ে গেছেন। যেমন বেক্সিমকো গ্রæপের বিভিন্ন কোম্পানির ৫ হাজার ২৬৯ কোটি টাকার ঋণ ২০২৬ সাল পর্যন্ত পুনঃতফসিল করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ি কোনো ঋণ তিনবারের বেশি পুনঃতফসিলীকরণ করা যায় না। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে বেক্সিমকো গ্রæপের কোনো কোনো কোম্পানির কোনো কোনো ঋণ সাতবার পুনঃতফসিলীকরণ করা হয়েছে।
এ বিশাল খেলাপী ঋণ সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেছেন, বাংলাদেশের খেলাপিদের বেশিরভাগই ইচ্ছেকৃত খেলাপি। ব্যবসা-বাণিজ্যে এমন কোনো কিছু গত কয়েক বছরে হয়নি যে, ব্যবসায় বিনিয়োগ করে এই বিপুল সংখ্যক খেলাপি হবে। ঋণ নিয়ে অন্য খাতে বিনিয়োগ করা, বিদেশে পাচার করার মতো ঘটনা এখানে ঘটে। আর চট্টগ্রাম ও খাতুনগঞ্জ কেন্দ্রীক যে খেলাপি ঋণ তার সিংহভাগই ইচ্ছেকৃত। কারণ এখানকার অনেক ব্যবসায়ী ঋণের অর্থ জমি কেনাসহ রিয়েল স্টেট খাতে বিনিয়োগ করেছে। গত তিন-চার বছর ধরে রিয়েল স্টেটের দাম বাড়েনি। ফলে খেলাপি হয়েছে।
আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় আসার পর সরকারের পরামর্শে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাদের রক্ষা ও সুবিধা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়েছে। গত ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে খেলাপি ঋণ ও অবলোপনের নতুন নীতিমালা জারি করা হয়েছে। সার্কুলার অনুযায়ি ২০১৯ সালের ৩০ জুন থেকে এই নীতিমালা কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও এক রিট আবেদেনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এর কার্যকারিতা ২৪ আগস্ট পর্যন্ত স্থগিত করেছে।
বর্তমানে কোনো ঋণের কিস্তি তিন মাস অনাদায়ী হলে সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ছয় মাস অনাদায়ী হলে সন্দেহজনক এবং ৯ মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে মন্দ ঋণ হিসেবে শ্রেণিকরণ করা হয়। নতুন সার্কুলারে বলা হয়েছে, সব ধরনের চলতি ঋণ, ডিমান্ড ঋণ, ফিক্সড টার্ম লোন অথবা যে কোনো ঋণের কিস্তি তিন মাসের বেশি, কিন্তু ৯ মাসের কম অনাদায়ী থাকলে তা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণ হিসেবে গণ্য করা হবে। আগে তিন মাসের বেশি অনাদায়ী থাকলে সাব-স্ট্যান্ডার্ড গণনা করা হতো। ৯ মাসের বেশি কিন্তু ১২ মাসের কম অনাদায়ী থাকলে তা ডাউটফুল লোন বা সন্দেহজনক ঋণ হবে। আগে ৬ মাসের বেশি ৯ মাসের কম অনাদায়ী ঋণকে ডাউটফুল লোন বা সন্দেহজনক ঋণ বলা হতো। আর ১২ মাসের বেশি অনাদায়ী ঋণ ব্যাড লোন বা মন্দ ঋণ হবে। আগে ৯ মাসের বেশি অনাদায়ী ঋণ মন্দ ঋণ হিসেবে বিবেচিত হতো।
ব্যাংক জনগণের আমানতের জিম্মাদার। ব্যাংকভেদে তার পুঁজির শতশত গুণ বেশি অর্থ নিয়ে কারবার করে ব্যাংক। তারা জনগণের আমানত ঋণ হিসেবে প্রদান করে। ঋণগ্রহীতা বাছাইয়ে ত্রæটি, পরিচালকদের অসততা-স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে বশ্যতা স্বীকার, সরকারের হস্তক্ষেপ, আইনের অপ্রতুলতা ও প্রয়োগের ঘাটতির জন্য জনগণের কষ্টার্জিত সঞ্চয় গুটি কয়েক ব্যক্তি তসরুফ করার সুযোগ পায়। অর্থমন্ত্রী সংসদে ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৯০ জন খেলাপি ঋণগ্রহিতার সংখ্যা দিয়েছেন। এর মধ্যে অনেক ক্রেডিট কার্ড, কনজিউমার ক্রেডিট, স্মল ক্রেডিট নেয়া ক্ষুদ্র ও ব্যক্তি পর্যায়ের ঋণগ্রহিতারাও রয়েছেন। মূলতঃ হাতেগোণা গুটিকয়েক গ্রæপ খেলাপি ঋণের জন্য দায়ি। এ লুটেরাগোষ্ঠী ব্যাংক লুটপাটের মাধ্যমে দ্রæত ধনী থেকে অতি ধনীতে রুপান্তরিত হচ্ছে। এভাবেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুটপাটের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন লুটেরা শ্রেণি ক্রমস্ফীত হচ্ছে।
ব্যাংকখাতে লুটপাট করার জন্য অর্থনীতিবিদ ব্যাংকাররা দীর্ঘদিন যাবত ব্যাংক কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছেন। সরকারও বিভিন্ন সময় এ দাবির প্রতি সহমত জানিয়েছে। এবারের বাজেটেও ব্যাংক কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো আজানা কারণে তা গঠিত হচ্ছে না। খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি থেকে ব্যাংক খাতকে মুক্ত করতে হলে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত করতে হবে। দলীয় বিবেচনায় পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। ব্যাংক মালিকানায় পারিবারিক প্রভাব বৃদ্ধির জন্য যে সংশোধনী ব্যাংক কোম্পানি আইনে করা হয়েছিল তা বাতিল করতে হবে। খেলাপি ঋণের মাধ্যমে জনগণের অর্থ আত্মসাৎকারী লুটেরা-গোষ্ঠী এবং তাদের আমলা রাজনৈতিক সহযোগীদের বিরুদ্ধে সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা