রিজার্ভ সংকটে ব্যবসায়ীরা নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন : এফবিসিসিআই সভাপতি
মো. আখতারুজ্জামান : [১] প্রশাসনিক জটিলতা, অর্থায়েনের সীমাবদ্ধতা করা হার সমস্যা, দক্ষ মানবসম্পদের অভাব এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশের অনুপস্থিতির কারণে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এছাড়াও বৈশি^ক অর্থনৈতিক সংকট, জ¦ালানি, শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের মূল্য বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের কারণে আমাদের ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচলনায় নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি মাহবুবুল আলম।
[২] বুধবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ডিসিসিআই অডিটরিয়ামে এক আলোচনা সভা তিনি এসব কথা বলেন।
[৩] মাহবুবুল আলম বলেন, দেশের ব্যবসায়ীরা সৎভাবে ও সম্মানের সাথে ব্যবসা ও বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায়। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের মানসিকতার পরিবর্তন।
[৪] এফবিসিসিআই’র সভাপতি জানান, ব্যবসা পরিচালন ব্যয় হ্রাসে আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি, মূল্যস্ফীতি হ্রাস এবং আগামীতে বাংলাদেশ একটি ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত করার লক্ষ্যে সরকার-বেসরকারিখাতের সমন্বয় অতীব জরুরী বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। কৃত্রিম ভাবে পণ্যের প্রাপ্তির সংকট ও মূল্য বৃদ্ধিকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি তিনি আহŸান জানান।
[৫] অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার বলেন, স্থানীয় উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনার উপর আমাদের অর্থনীতির সাফল্য অনেকাংশে নির্ভরশীল। কারণ বাজারের অব্যবস্থাপনার কারণে ব্যবসায়ীক কার্যক্রম পরিচালনায় উদ্যোক্তারা যেমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন, তেমনই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও মানের হ্রাসের ফলে ভোক্তারা মানসম্মত পণ্য প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হন। তিনি ব্যবসায়ীদের হয়রানি মুক্ত ব্যবসায়ীক কার্যক্রম পরিচালনা, ভোক্তা অধিকার সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সচেতনতা বৃদ্ধির উপর জোর দেন।
[৬] ব্যারিস্টার সাত্তার ভ্যাট রিটার্ন প্রক্রিয়া পুরোপুরি অনলাইন ও অটোমেটেড হওয়া প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন এবং ব্যবসা পরিচালন ব্যয় হ্রাসে যৌক্তিক হারে ভ্যাট কমানোর আহŸান জানান। এছাড়াও কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়া দ্রæতকরণ, বিএসটিআই’র সক্ষমতা বাড়ানো এবং এনবিআর, ট্যারিফ কমিশন, প্রতিযোগিতা কমিশনসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থার মধ্যকার সমন্বয় বৃদ্ধির জন্য তিনি আহŸান জানান।
[৭] ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, বাজারে স্থিতিশীলতা আনায়নে বেসরকারি খাত এবং সরকারি সংস্থার মধ্যকার সমন্বয় একান্ত আবশ্যক। বিশেষ করে কলকারখান ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ও শ্রম অধিদপ্তরের কার্যক্রমের সমন্বয় বিশেষভাবে প্রয়োজন।
[৮] প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের তৈরি পোষাক খাতের কমপ্লায়েন্স বৈশি^ক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। অন্যান্য খাতেও কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে। দেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে সহায়ক নীতিমালা নিশ্চিত করা একান্ত অপরিহার্য। আমাদের ব্যবসায়ীক কাজে প্রয়োজনীয় স্যাম্পল ছাড়া করতে যদি সময় বেশি লাগে, তাহলে ব্যবসা চলে যাবে ভিয়েতনামসহ প্রতিযোগী অন্যান্য দেশগুলোতে। তাই এক্ষেত্রে সহজীকরনের কোন বিকল্প নেই।
[৯] উত্তর সিটি মেয়র আরো বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কে আরো সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যবসা পরিচালন ব্যয় হ্রাসে সংশ্লিষ্ট নীতিমালা সমূহ দ্রæত সংষ্কার একান্ত আবশ্যক বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন।
[১০] তিনি আরো বলেন, যারা ব্যবসা পরিচালনায় অসাধু পন্থা অবলম্বন করছেন, তাদেরকে সনাক্ত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সিটি কর্পোরেশনে সকল সেবা দ্রæতসময়ে ও স্বচ্ছতার সাথে নিশ্চিতের লক্ষ্যে সবার ঢাকা অ্যাপস চালু করা হয়েছে। নগরবাসীকে তা ব্যবহারের আহŸান জানান।
[১১] আতিক জানান, উত্তর সিটি কর্পোরেশন অঞ্চলে স্টার্ট আপ উদ্যোক্তাদের জন্য ‘পিও’ বক্স প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং উত্তর সিটি কর্পোরেশন আতওতাভুক্ত অঞ্চলের জন্য ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তি সেবা অনলাইনে আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। যেটি উদ্যোক্তাদের সময় ও ব্যয় হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
[১২] তিনি জানান, উত্তর সিটি কর্পোরেশনের গুলশান-২-এর ট্রাফিক সিনগ্যালগুলো এআই’র মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য জায়গায় তা বাস্তবায়ন করা হবে। ইলেকট্রনিক বাস সার্ভিস চালুকরণে লক্ষ্যে বাস আমদানি ও রুট পার্মিট প্রদানে ক্ষেত্রে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ হতে সকল সহযোগিতা প্রদান করা হবে। এ ব্যাপারে উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার আহŸান জানান।
[১৩] বিশেষ অতিথি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, তেল-চিনি বেশকিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের স্থানীয় চাহিদা আমরা আমদানির মাধ্যমে মেটাতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যের অস্থিতিশীলতার কারণে দেশীয় বাজারে পণ্যের মূল্যে অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে স্থানীয় বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতার কারণেও আমাদের পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে ভোক্তারা মূল্যস্ফীতির শিকার হচ্ছেন।
[১৪] বাণিজ্য সচিব বলেন, ব্যবসায়ীক কর্মকাÐ পরিচালনায় সরকারের কিছু নীতিমালা ও নিয়ম রয়েছে, এগুলোর ব্যবহারে উদ্যোক্তারা আরো বেশি হারে সচেতন হলে হয়রানি সহ অনেক ক্ষেত্রে আনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব। তিনি পাইকারী পর্যায়ে ক্যাসলেস পেমেন্টন সিস্টেম প্রবর্তন এবং পাকা রশিদ প্রদান নিশ্চিত করা সম্ভব হলে, দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রনে আরো কার্যকর ফল পাওয়া যাবে।
[১৫] বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপার্সন প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মাঝে গ্যাপ রয়েছে, যেটি নিরসন করা দরকার। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারিখাতের অবদান প্রায় ৮২ শতাংশ এবং বেসরকারি খাতের উন্নয়নে সহায়ক নীতি সহায়তা প্রদানে সরকার বদ্ধ পরিকর।
[১৬] ক্যাব’র কোষাধ্যক্ষ ড. মো. মনঞ্জুর-ই-খোদা তরফদার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের মধ্যকার ইকো-ফ্রেন্ডলি বিজনেস এনভায়রনমেন্ট নিশ্চিতকরণের উপর জোরারোপ করেন।
[১৭] কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপমহা-পরিদর্শক মো. মেহেদী হাসান বলেন, এ অধিদপ্তর হতে দোকান পরিদর্শন করা হলে মূলত ২৫টি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। বর্তমানে অনলাইনেই কলকারখানা অধিদপ্তরের লাইসেন্স প্রাপ্তি সম্ভব।
[১৮] ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, অসাধু চক্রের কারণে আমাদের সৎ ও সত্যিকারের ব্যবসায়ীরা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে, যা রোধে সকলের যৌথ ও সমন্বিত উদ্যোগ একান্ত অপরিহার্য।