মামলা নয়, ড. ইউনূসকে গুডউইল এম্বাসেডর করুন
রুমি আহমেদ
১৯৯৬ সালের কথা। আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েট শহরে থাকি। ওয়েইন স্টেট ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ মেডিসিনে মোলেকুলার বায়োলজি ও জেনেটিক্সের গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট। খবর পেলাম একঘণ্টা দূরে এন আরবার এ ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানে ড. ইউনূস আর ডা. জাফরুল্লাহ আসছেন। ইউনিভার্সিটির ল স্কুলের সেন্টেনারি উপলক্ষে বিশাল প্রোগ্রাম। একটা মেইন প্লেনারি সেশনে বক্তা হচ্ছেন ড. ইউনূস, ডা. জাফরুল্লাহ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রধান, সদ্য আয়রন কার্টেইন থেকে মুক্তি পাওয়া পূর্ব ইউরোপীয় দেশের এক রাষ্ট্রপ্রধানÑ নাম ভুলে গেছি, আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রধান। আর সম্ভবত সদ্য নোবেল লরেট ডেসমন্ড টুটু। আগে আগেই পৌঁছে গেলাম বিশাল অডিটোরিয়াম। হাজার হাজার মানুষ। সবাই ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের ছাত্র-ছাত্রী ফ্যাকাল্টি। তিল পরিমাণ জায়গা নেই। হাঁটার জায়গা, সিঁড়ি সবখানেই ফ্লোরের মধ্যে ছাত্র ছাত্রীরা বসে আছে। আমি ফার্মগেট পীরজঙ্গীমাজার ছয় নম্বর বাসের পাদানিতে একটা বুড়ো আঙ্গুল গ্যাটিস দিয়ে চলা-ফেরা করে অভ্যস্ত ভিড়ের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে করতে একেবারে নিচে চলে গেলাম, আর স্টেজের নিচে ফ্লোরের মধ্যে বসার জায়গা করে নিলাম। বক্তারা একে একে ৩০ মিনিটের স্পিচ দিলেন। স্মৃতি ঘোলাটে হয়ে গেছে। ডেসমন্ড টুটু বা ওই স্ট্যাচারের কেউ মনে হয় শেষ বক্তা। তার ঠিক আগেই ইউনূস। উনি তখন নোবেল লরেট না- উনি নোবেল পাবেন আরো দশ বছর পর। ইউনূস যে ত্রিশ মিনিট স্পিচ দিলেন, ওটা আমার জীবনে একটা হাইয়েস্ট পয়েন্ট হয়ে থাকবে।
উনি অবিশ্বাস্য কুশলতার সঙ্গে দুটো বেসিক কনসেপ্টÑ মাইক্রো ক্রেডিট আর সোশ্যাল বিজনেস বুঝিয়ে দিলেন। ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানে আমেরিকার টপ স্কুলগুলোর একটা। এখানে যারা পড়াশোনা করছে। বিশেষ করে ল স্কুলে- তারাই আমেরিকার ভবিষ্যৎ ড্রাইভিং ফোর্স। একজন মানুষ যে এই পশ্চিমা ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে এতো ইন্টারেকটিভ হয় এনগেজ করতে পারেন, তা নিজের চোখে না দেখলে জানতাম না। ওরা মূহুর্মূহ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে মেঝে থেকে, থেমে থেমে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিচ্ছে আর ড. ইউনূসের জোকগুলো পুরোপুরি উপভোগ করছে। প্রচÐ ভিড়ে আর কোথাও জায়গা না পেয়ে আমি স্টেজের গায়ে পিঠ দিয়ে ফ্লোরে বসে ছিলাম। আমার মুখ ছিল ছাত্রদের দিকে। আমি ইউনূসকে দেখতে পারছিলাম না। কিন্তু অডিটোরিয়াম ভর্তি ছাত্রদের দেখতে পারছিলাম। ওদের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিলো ওরা কতটা উজ্জীবিত। ভাবলেশহীন মুখগুলো সব বদলে গেলো আধা-ঘণ্টার ব্যবধানে। এদের সবার চোখে মুখে আশার আর উদ্দীপনার আলো। ইউনূসের পরে যে এসেছিলেন সেই বক্তা তো বললেনই, ‘আমার মনে হচ্ছে লাইভ এইডে ফ্রেডি মার্কারির পারফর্মেন্সের পরই স্টেজে এলাম’। সবার স্পিচ শেষে প্রশ্নোত্তর পালাÑ মাইক্রোফোনের সামনে লম্বা লাইন প্রশ্ন করার জন্য। ৯০ শতাংশ প্রশ্ন ইউনূসকে ডিরেক্ট করা। বাংলাদেশি হিসেবে গর্বে আমার বুক ফুলে আকাশ ছুঁয়েছিল সেদিন। ১৯৯৬ সালে যারা ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানে ল স্টুডেন্ট ছিল, তারা আজ আমেরিকায় নিজ নিজ ফিল্ডে কর্তা ব্যক্তি। এরাই আজ আমেরিকা শুধু না। এরা পৃথিবী চালায়। আমি শুনেছি ইউনূস সাহেব আমেরিকা-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে টপ ইউনিভার্সিটিগুলোতে গিয়েছেন, স্পিচ দিয়েছেন।
ইউনূসের জন্য যে এতো হাই প্রোফাইল বিবৃতি- তা যতটা না টপ লেভেল কো-অর্ডিনেশন তার চেয়ে বেশি হচ্ছে ১৯৮০-৯০ দশক থেকে পৃথিবীর টপ ইউনিভার্সিটিগুলোতে ছাত্রদের সাথে যে সময় কাটিয়েছেন তার রেজাল্ট। উনি পৃথিবীর এইসব টপ ০.০১% স্টুডেন্টদের প্রচÐভাবে ইন্সপায়ার করতে পেরেছিলেন, সোশ্যাল এন্ট্রেপ্রেনারশিপ আইডিয়াটা সেল করতে পেরেছিলেন। ওঁরা আজ যার যার পজিশন থেকে ইউনূসের জন্য কাজ করছেন (এই ব্র্যাকেটবন্দি অংশটা নিচে লেখা ডা. আবু নাসের সুমন ভাইয়ের মন্তব্য থেকে কপি করে এখানে ইনসার্ট করলাম রিলেভেন্ট বলেÑ উৎ. ণঁহঁং ধিং মরাবহ ঃযব যড়হড়ৎ ড়ভ ংঢ়বধশরহম ধঃ ঃযব পড়সসবহপবসবহঃ ংঢ়ববপয ধঃ টঈঝউ, টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঈধষরভড়ৎহরধ, ঝধহ উরবমড়, পড়ঁঢ়ষব ড়ভ ুবধৎং ধমড়. ঞযবৎব ধিং ংঁপয ধ যঁমব ঃঁৎহড়ঁঃ ঃযধঃ টঈঝউ ংঃধৎঃবফ ংবষষরহম ঃরপশবঃং হবীঃ ুবধৎ যিবহ উধষধর খধসধ পধসব ঃড় ংঢ়বধশ. ঞযব ঢ়ড়বিৎ ড়ভ ংড়পরধষ পঁৎৎবহপু ধহফ ুড়ঁঃয বহঃৎবঢ়ৎবহবঁৎংযরঢ় পড়হপবঢ়ঃ যব রহভঁংবফ ধহফ ঃযব ৎড়ঁহফরহম ধঢ়ঢ়ষধঁংব যব ৎবপবরাবফ ংঃরষষ ৎবাবৎনবৎধঃবং ধষড়হম ঃযব টঈঝউ পধসঢ়ঁং. ঐরং রফবধ ড়ভ ুড়ঁহম ংঃঁফবহঃং ঃড় ঃযরহশ ধং নঁংরহবংং ড়হিবৎং হড়ঃ বসঢ়ষড়ুববং পধঃধঢ়ঁষঃবফ ষড়ঃং ড়ভ ুড়ঁহম বহঃৎবঢ়ৎবহবঁৎং রহঃড় বীরংঃবহপব)
বাংলাদেশে আজ কেউ যদি বলেন, ইউনূস সুদ খেয়েছেনÑ গিভ মি এ ব্রেক। কোন ব্যাংক ইন্টারেস্ট ফ্রি ব্যাংক? কোনো ব্যাংক কি আছে যারা সুদ নেয় না? ইসলামী ব্যাংকও নেয়, অন্য নামে নেয়। বাংলাদেশে আজ তো সবচেয়ে বড় মাক্রোক্রেডিট লেন্ডার হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। আর লেবার ল। শ্রমিকের কান্না। কী আর বলবো। যখন রানা প্লাজার ধ্বংসবাস্তুপের নিচে চাপা পড়া হাজার হাজার শ্রমিক উদ্ধারের জন্য আকুতি করছিলো, যখন দুদিন পরপর কলাপ্সিবল গেটের ভিতরে ডজন ডজন জীবন্ত ফ্রাই হয়- আমাদের সরকারগুলো ওই মালিকদের রক্ষা করার জন্য অস্থির হয়ে যায়, তখন কোথায় থাকে শ্রমিকের অধিকারের প্রশ্ন? রানা প্লাজার রানা এখন কোথায় তা কী জানেন? আর ট্যাক্স; নিজেকে জিজ্ঞেস করে দেখুন তো আপনি বাংলাদেশে এই পর্যন্ত যা ইনকাম করেছেন তার কড়ায় গন্ডায় ট্যাক্স শোধ করছেন কী? আমি বুঝি না ড. ইউনূস তো বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন দেশের যতো সমস্যা অন্যায়ের সময়েও মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন তারপরও ওনার উপর এতো ক্ষোভ কেন। ওনার পিছনে না লেগে ওনাকে কাজে লাগাই না কেন আমরা? ইউনূস সাহেব ওই ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান ল স্কুলের বিশ্ব সেরা ছাত্রছাত্রীদের মতো সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ তরুণ মনকে উদ্দীপিত করেছেন। ৮০, ৯০, ০০ দশকের সেই তরুণ রাই আজ জাজ, সিইও, সিনেটর, কেবিনেট মেম্বার, চিফ একজিকিউটিভ, প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টার, ইউনিভার্সিটি চ্যান্সেলর ইত্যাদি। ড. ইউনূস চাইলে এদের দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নিতে পারেন বাংলাদেশ এর জন্য। মামলা নয়, ড. ইউনূসকে গুডউইল এম্বাসেডর করুন। দেশের জন্য উনি অনেক কিছু আনতে পারবেন। যদি এরশাদের মতো একজন চরম দুর্নীতিবাজ লোককে গুডউইল এম্বাসেডর করতে পারেন, ড. ইউনূস কে কেন নয়?
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ