
রাজস্ব প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে

এবি সিদ্দিক
বিশে^ যেসব দেশে কর-জিডিপির অনুপাত কম, বাংলাদেশ তার একটি। ফলে দেশটি প্রয়োজনীয় খাতগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে পারছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বর্তমানে যতটা শুল্ক-কর আদায় করে থাকে, ভবিষ্যতে এর চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে। হিসাব করে দেখা যাক, কী পরিমাণ বাড়তি কর আদায় করতে হবে। ২০১৫-১৬ সালের ভিত্তি বছর ধরা হলে আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের জিডিপির আকার ছিলো ৩৫ লাখ ৩০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে ১৭ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। অবশ্য গত দুই বছরে জিডিপির আকার আরও বেড়েছে। মোটাদাগে বলা যায়, এনবিআর এখন যে প্রবণতায় কর আদায় করছে, সেই প্রবণতা ধরে রাখার পাশাপাশি আগামী কয়েক বছর বাড়তি ২০ হাজার কোটি টাকার মতো শুল্ক-কর আদায় করতে হবে। ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ হারে শুল্ক-কর আদায় বাড়াতে হবে। এরপর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কর-জিডিপি অনুপাত দশমিক ৭ শতাংশ বাড়াতে হবে। কীভাবে কর আদায় বৃদ্ধি করা যায়, তা নিয়ে একটি কৌশল ঠিক করতে হবে বাংলাদেশকে। এ কাজে আইএমএফ কারিগরি সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে। আইএমএফের ২০২৩ সালের প্রথম পর্যালোচনার আগেই এ কাজ করতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বর্তমানে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। আইএমএফ মনে করে, বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত কম হওয়ার কারণ, এ দেশে বিপুল পরিমাণ কর অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া জটিল করব্যবস্থা, দুর্বল কর প্রশাসন এসব কারণে কর আদায় কম হয়। ফলে সরকারকে বিপুল অর্থ ঋণ করতে হয়।
এদিকে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম গতিশীল করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে আয়কর ও কাস্টমসের অফিস সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ৪২ হাজার জনবল বাড়ানোর প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। জনবল বৃদ্ধি ও অফিস সম্প্রসারণের প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছেন বলে জানা যায়। কাস্টমসের প্রস্তাবও অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অনুমোদনকৃত প্রস্তাব অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে শিগগিরই পাঠানো হবে। দায়িত্বশীল আয়কর ও কাস্টমস বিভাগ থেকে দুটি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এতে নতুন আয়কর অফিস, ভ্যাট কমিশনারেট ও কাস্টম হাউস গঠন-সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা তুলে কথা বলা হয়েছে। কাস্টমস-ভ্যাটের নতুন ১৯টি দপ্তর এবং আয়করের ৪৫টি অফিস স্থাপন করার কথা বলা হয়েছে। একইসঙ্গে কাস্টমস-ভ্যাটে ১৭ হাজার ৩১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আয়করে ২৫ হাজার কর্মকর্তা নিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
অর্থমন্ত্রী আয়করের প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছেন। কাস্টসমের প্রস্তাবও অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। আয়কর অনুবিভাগ সংস্কার, পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে ১০০ উপজেলায় আয়কর অফিস করা হবে। নতুন ৪৫টি কর অঞ্চল গঠন করা হবে। বর্তমানে দেশব্যাপী আয়কর অফিসের সংখ্যা ৪০টি। আয়কর বিরোধ ব্যবস্থাপনা ইউনিট, আয়কর যোগাযোগ, সেবা ও এস্টেট ইউনিট, ই-ট্যাক্স ব্যবস্থাপনা ইউনিট, আয়কর গোয়েন্দা, তদন্ত ও এনফোর্সমেন্ট ইউনিট, কর তথ্য ব্যবস্থাপনা ইউনিট, আন্তর্জাতিক কর ইউনিট এবং উৎসে কর ব্যবস্থাপনা ইউনিট নামে সাতটি বিশেষায়িত ইউনিট স্থাপন করা হবে। এছাড়া নতুন ছয়টি কর আপিল অঞ্চল করা হবে। বর্তমানে আয়কর বিভাগে ৯ হাজার জনবল কর্মরত আছে। নতুন কাঠামোতে আরও ২৫ হাজার জনবল নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালে আয়কর বিভাগে সংস্কার-সম্প্রসারণ হয়েছিল। এরপর আয়কর প্রশাসনে সংস্কার, সম্প্রসারণ হয়নি। সময়ের পরিক্রমায় আয়করের পরিধি বাড়লেও আগের অফিস ও জনবল দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। এ কারণে সরকার যথাযথ রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ ২০১১ সালে ৩১টি কর অঞ্চলে আট লাখ রিটার্ন জমা পড়ত। এখন প্রায় ২৩ লাখ রিটার্ন জমা পড়ে। প্রতিটি বেতনভোগী সার্কেলে প্রায় ২০ হাজারের বেশি রিটার্ন জমা পড়ছে। এসব রিটার্ন প্রসেসের জন্য কর্মকর্তারা উপযুক্ত সময় পান না।
২০২৪ সালে দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। রিটার্ন জমা পড়বে ৫০ লাখের বেশি। আর ২০৩০ সাল নাগাদ রিটার্ন জমা পড়বে এক কোটি ২০ লাখের মতো। এতো বিপুলসংখ্যক রিটার্ন প্রসেস করার জন্য বিদ্যমান আয়কর কাঠামোর সমক্ষতা নেই। অন্যদিকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে আইটিভিত্তিক নানা ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটবে। এ ধরনের ব্যবসার আয় থেকে বর্তমান কাঠামো দিয়ে কর আদায় সম্ভব নয়। তাই প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়াতে আয়কর বিভাগের সংস্কার ও সম্প্রসারণের বিকল্প নেই। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমকে গতিশীল করতে এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে কাস্টমসের পরিধিও বাড়ানো হচ্ছে।
ভ্যাট কমিশনারেট ও কাস্টম হাউস গঠন-সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে ১৯টি নতুন দপ্তর গঠন এবং এসবে ১৭ হাজার ৩১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের প্রস্তাব অভ্যন্তরীণ সম্পদ মন্ত্রণালয় (আইআরডি) থেকে অর্থমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। কাস্টমসকে আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে নিজস্ব রাসায়নিক পরীক্ষাগার স্থাপন, রেভিনিউ ফোর্স, অর্থপাচার রোধে মানি লন্ডারিং ও চোরাচালান প্রতিরোধ অধিদপ্তর এবং ইকোনমিক জোনে কমিশনারেট গঠন করতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। একই সঙ্গে ভ্যাট আদায় বাড়াতে নতুন চারটি ভ্যাট কমিশনারেট গঠন এবং রপ্তানিমুখী শিল্পের স্বার্থে ঢাকা বন্ড কমিশনারেটকে দুই ভাগ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বর্তমানে ছয়টি কাস্টম হাউস আছে। এগুলো হলো- চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, ঢাকা কাস্টম হাউস, বেনাপোল কাস্টম হাউস, মোংলা কাস্টম হাউস, পানগাঁও কাস্টম হাউস ও কমলাপুর আইসিডি। এতে বর্তমানে দুই হাজার ৩৪৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছে।
এসব কাস্টম হাউসে নতুন করে দুই হাজার ৩৩৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে নতুন চারটি কাস্টম হাউস গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এগুলো হলো- চট্টগ্রাম বে-কাস্টম হাউস, ভোমরা কাস্টম হাউস, পায়রা কাস্টম হাউস ও চট্টগ্রাম আইসিডি। এতে এক হাজার ৬৩৬ জন নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বর্তমানে কাস্টমস বিভাগের কর্মকর্তাদের কাজের ধরণ বদলেছে। রাজস্ব আদায়ের চেয়ে বর্ডার নিরাপদ রাখা এবং বাণিজ্য সহজীকরণে কাস্টমসে কাজ করতে হয়। তাই অর্থপাচার রোধে মানি লন্ডারিং ও চোরাচালান প্রতিরোধ অধিদপ্তর করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ব্যবসা সহজীকরণের অংশ হিসেবে নিজস্ব রাসায়নিক ল্যাব গঠন এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলভিত্তিক কমিশনারেট গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এসব প্রস্তাব অনুমোদিত হলে একদিকে বন্দও থেকে ব্যবসায়ীরা দ্রæত পণ্য খালাস করতে পারবেন। অন্যদিকে অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীরা দ্রæত সেবা পাবেন। জনবল নিয়োগ ও দপ্তর সম্প্রসারণের প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। জনপ্রশাসনের অনুমোদন পাওয়া গেলে দ্রæত মাঠ পর্যায়ে অফিস সম্প্রসারণের কাজ শুরু করা হবে।
কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে রাজস্ব প্রশাসনের সংস্কার প্রয়োজন আছে। তবে এর সঙ্গে এনবিআরের অধীনস্থ দপ্তরগুলোর মধ্যে প্রযুক্তিগত যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। তাহলে ব্যবসায়ীদের হয়রানি কমবে। সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে। মধ্যম আয়ের দেশের আলোকে রাজস্ব বিভাগের ফ্রেমওয়ার্ককে আপগ্রেড করতে হবে। এনবিআর গৃহীত এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে রাজস্ব খাতে গতি বাড়বে, সেই সাথে কর জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌঁছাবে। তবে রাজস্ব প্রশাসনে সংক্ষারের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, খুবই সময়োপযোগী[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশ ও কার্যকর হবে বলে আমি আশাবাদী। সেই সাথে কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক
