ভারত একটি অনিচ্ছুক ব্রিকস সদস্য!
এম কে ভদ্রকুমার
ব্রিকস বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বশীল স¤প্রদায়ে রূপান্তরিত হচ্ছে, একটি বর্ধিত সদস্যপদ যা পশ্চিমা চাপকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছে। জোহানেসবার্গে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের দৌড়ে ভারত অল্প সময়ের জন্য পশ্চিমা মিডিয়ার জন্য আশার আলো হয়ে উঠেছে, একটি সম্ভাব্য ভিন্নমত যা একটি ‘ডি-ডলারাইজেশন’ প্রক্রিয়ার দিকে গ্রæপিংয়ের ত্বরণকে ত্বরান্বিত করতে পারে। রয়টার্স একটি গুজব ছড়িয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ব্যক্তিগতভাবে শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে পারেন না, যা অবশ্যই ইচ্ছাকৃত চিন্তার অত্যধিক বিষয় ছিল তবে ব্রিকস কী একটি ভ‚-রাজনৈতিক খেলা হয়ে উঠেছে? এমন বিড়ম্বনা ছিল নজিরবিহীন। যদি গত বছর পর্যন্ত, পশ্চিমারা ব্রিকসকে অপ্রয়োজনীয় হিসাবে উপহাস করে, পেন্ডুলামটি চরমে চলে গেছে। কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। সবচেয়ে সুস্পষ্ট স্তরে, পশ্চিমা বিশ্বে অত্যন্ত সংবেদনশীলতা রয়েছে যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাগুলোকে অস্ত্র দেওয়ার জন্য বিগত ১৮ মাস ধরে ব্যাপক প্রচেষ্টা কেবল ফ্লপ হয়নি বরং বুমেরাং হয়েছে এবং এটি এমন এক সময়ে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চীনকে ছাপিয়ে যাওয়ার ভীতি তুঙ্গে উঠেছিল – ১৫ শতকের ‘ভৌগোলিক আবিষ্কার’ থেকে পশ্চিমের বৈশ্বিক আধিপত্যকে সমাপ্ত করে।
সা¤প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া-চীন অংশীদারিত্বের একটি স্থির শক্তিশালীকরণ প্রত্যক্ষ করেছে, যা পশ্চিমা হিসাবনিকাশের বিপরীতে ‘কোন সীমাহীন’ চরিত্রে পৌঁছেছে যা ঐতিহাসিক দ্ব›দ্ব কার্যত এমন একটি সম্ভাবনাকে বাতিল করে দিয়েছে। বাস্তবে রাশিয়া-চীন অংশীদারিত্ব একে অপরের মূল স্বার্থকে সমর্থন করার সাথে সাথে প্রতিটি জাতীয় স্বার্থের সর্বোত্তম অনুসরণের নিরবিচ্ছিন্ন সহনশীলতার মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক জোটের চেয়ে বড় কিছু হিসাবে রূপ নিচ্ছে। সুতরাং যে কোনও ফরম্যাটে যেখানে রাশিয়া এবং চীন প্রধান ভ‚মিকা পালন করে, যেমন ব্রিকস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে থাকতে বাধ্য। এটা সহজ হিসাব। নিউইয়র্ক টাইমস ব্রিকস স¤প্রসারণকে ‘গ্রæপের দুই নেতৃস্থানীয় সদস্যের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য বিজয়, চীনের রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি এবং রাশিয়ার বিচ্ছিন্নতা কমাতে সাহায্য করে’ বলে বিবেচিত হয়েছে বলে প্রতিবেদন করেছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ মিডিয়ার কাছে প্রকাশ করেছেন যে বন্ধ দরজার আড়ালে, জোহানেসবার্গ শীর্ষ সম্মেলনে ‘বেশ প্রাণবন্ত আলোচনা’ হয়েছিল।‘প্রার্থীদের ওজন, বিশিষ্টতা এবং গুরুত্ব এবং তাদের আন্তর্জাতিক অবস্থান ছিল আমাদের [ব্রিকস সদস্যদের] প্রাথমিক কারণ। এটা আমাদের এমন দৃষ্টিভঙ্গি যে আমাদের অবশ্যই সমমনা দেশগুলোকে আমাদের পদে নিয়োগ করতে হবে যারা বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থায় বিশ্বাস করে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের প্রয়োজন। গেøাবাল গভর্নেন্সে গেøাবাল সাউথের জন্য যারা বড় ভ‚মিকা পালন করে তাদের আমাদের প্রয়োজন। যে ছয়টি দেশ আজকে যোগদানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তারা এই মানদÐগুলো সম্পূর্ণরূপে পূরণ করে।’
পরে জোহানেসবার্গ থেকে মস্কোতে ফেরার পর, ল্যাভরভ রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলেছিলেন: ‘আমরা [ব্রিকস] কারো স্বার্থ দখল করতে চাই না। আমরা কেবল চাই না যে কেউ আমাদের পারস্পরিক উপকারী প্রকল্পগুলোর উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করুক যা কারও বিরুদ্ধে লক্ষ্য করা যায় না।’ পশ্চিমা রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিকরা ‘তাদের জিহŸা নাড়াতে থাকে, যখন আমরা আমাদের মাথা ব্যবহার করি এবং কংক্রিট ইস্যুতে [নিয়োজিত] থাকি।’
এখন এ২০-এর বিকল্প হওয়ার জন্য ব্রিকস-এর কোনো প্রয়োজন নেই। তাতে বলা হয়েছে, ‘জি২০ গ্রæপের জি৭+ এবং ব্রিকস+এ আনুষ্ঠানিক বিভাজন একটি বাস্তব রূপ নিচ্ছে।’যদি কেউ মায়োপিক না হয়, ব্রিকসের দিকনির্দেশনা সবার জন্যই দেখা যায়। ব্রিকস স¤প্রসারণের যুক্তি নিয়ে বকবক করা এবং হাত-পা বাঁধা সম্পূর্ণ বাজে কথা। কেননা, অব্যক্ত গোপন রহস্য এখানেই রয়েছে, যেমন একজন নেতৃস্থানীয় রাশিয়ান কৌশলগত চিন্তাবিদ ফিওদর লুকিয়ানভ সরকারি দৈনিক রসিয়স্কায়া গেজেটাতে লিখেছেন: ‘আমরা খুব কমই পশ্চিমা-বিরোধী অভিযোজন সম্পর্কে কথা বলতে পারি রাশিয়া এবং এখন সম্ভবত ইরান বাদে, বর্তমান এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যতের [ব্রিক্স] অংশগ্রহণকারীদের কেউই প্রকাশ্যে পশ্চিমের বিরোধিতা করতে চায় না। যাইহোক, এটি আসন্ন যুগকে প্রতিফলিত করে, যখন বেশিরভাগ রাজ্যের নীতি তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য অংশীদারদের একটি ধ্রæবক পছন্দ এবং বিভিন্ন সমস্যার জন্য বিভিন্ন প্রতিক‚লতা থাকতে পারে।’ এই কারণেই ভারত, যেটি তার ‘মাল্টি-অ্যালাইনমেন্ট’-এর লাইনকে সাবধানে রক্ষা করে অর্থাৎ সবার সঙ্গে সহযোগিতা একটি বৃহৎ এবং ভিন্ন ভিন্ন ব্রিকস নিয়েও সন্তুষ্ট। দিল্লি ব্রিকস স¤প্রদায়ের মধ্যে বিরোধী মনোভাবকে প্রসারিত করতে কম আগ্রহী। ভারতীয় ভাষ্যকাররা এই প্যারাডক্স ধরতে পারেন না। প্রকৃতপক্ষে, উপসাগরীয় অঞ্চলের তিনটি প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ (ইরান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত) স্বীকার করার বাস্তববাদ শুধুমাত্র সেই ইঙ্গিত দেয় যে ল্যাভরভ ‘প্রকল্প’ এবং‘কংক্রিট ইস্যু’ দ্বারা কি বোঝাতে চেয়েছিলেন যেগুলোর সাথে ব্রিকস লড়াই করছে – মূলত, একটি নতুন সৃষ্টি পাশ্চাত্যের তৈরি পাঁচ শতাব্দীর পুরনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করার জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা, যা মহানগরে সম্পদ স্থানান্তর করার জন্য প্রস্তুত ছিল এবং পরবর্তীকে আরও মোটা ও ধনী হতে সক্ষম করেছিল।
মূলত এটি আজ পেট্রোডলারের ঘটনাকে মোকাবেলা করার বিষয়ে, যা পশ্চিমা ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্তম্ভ এবং ‘ডি-ডলারাইজেশন’ প্রক্রিয়ার একেবারে মূল অংশ যা ব্রিকস লক্ষ্য করছে। বলাই যথেষ্ট ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকের ফাউস্টিয়ান চুক্তির উপর পর্দা নেমে আসছে যা আমেরিকান ডলারের সাথে সোনা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল এবং নিশ্চিত করেছিল যে তেলের লেনদেন হবে ডলারে, যার ফলস্বরূপ সমস্ত দেশকে তাদের রিজার্ভ ডলারে রাখতে হবে এবং অবশেষে পরিণত হয়েছিল মার্কিন বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের প্রধান প্রক্রিয়া। অন্যভাবে সৌদি আরব ব্যারিকেডে না থাকলে পেট্রোডলার ফিরিয়ে আনা কিভাবে সম্ভব? এটি রাশিয়া এবং সৌদি আরব সহ সমস্ত সদস্য রাষ্ট্র দ্বারাও ভালভাবে বোঝা যায় যে ব্রিকস ‘অ-পশ্চিমী’ হলেও ব্রিকসের একটি পশ্চিমা বিরোধী জোটে রূপান্তর অসম্ভব। সূ²ভাবে আমরা ব্রিকস এর স¤প্রসারণে যা দেখছি, তাই হল বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বশীল স¤প্রদায়ে এর রূপান্তর, যার সদস্যরা পশ্চিমা চাপকে উপেক্ষা করে যোগাযোগ করে। একই সময়ে, মূল কথা হল ব্রিকস স¤প্রসারণকে পশ্চিমে রাশিয়া ও চীনের রাজনৈতিক বিজয় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। চীনের সাথে তার উত্তেজনা থাকা সত্তে¡ও, পরিবর্তনের হাওয়া অনুধাবন করার সময় এবং ব্রিকস সহযোগিতা গ্রæপিংয়ের কার্যকারিতায় নতুন প্রাণশক্তি সঞ্চার করতে পারে এবং বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নের শক্তিকে আরও শক্তিশালী করতে পারে বলে অনুমান করার সময় ভারত সেই অনুযায়ী তার পাল ছাঁটাই করে সঠিক কাজটি করেছে। সীমান্ত ইস্যুতে চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে জিম্মি করে রাখার কৌশলের কার্যকারিতা নিয়ে সরকার পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে।
এম কে ভদ্রকুমারÑ একজন প্রাক্তন ক‚টনীতিক, তিনি উজবেকিস্তান ও তুরস্কে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সূত্র : কনসোর্টিয়ামনিউজ। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ