
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং স্মেয়ারিং ক্যাম্পেইন

অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে দেশে মারাত্মক একটা স্মেয়ারিং ক্যাম্পেইন চলছে। টিভি কিংবা পত্রিকা খুললেই ইউনূস কতো খারাপ, আর ইউনূস কতো ষড়যন্ত্র করছে এই নিয়ে আলোচনা আর বিবৃতিতে ভরপুর। এই সরকার গত ১৩টি বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে এই মানুষটির পেছনে লেগে এই মানুষটিকে নানাভাবে অপমান অপদস্ত করেছে। এর মাত্রা বাড়তে বাড়তে এখন এই পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ? ইউনূস দায়ী। পশ্চিমা দেশ বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকা বাংলাদেশে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য চাপ দিচ্ছে? এর জন্যও ইউনূস দায়ী। ১০৬ জনের বেশি নোবেল বিজয়ীসহ ১৬০ জনের বেশি বিশ্ব বরণ্য ব্যক্তি ইউনূসকে হেনস্থা না করার জন্য অনুরোধ করে খোলা চিঠি দেওয়ায় সরকার ক্ষুব্ধ হয়েছে। সরকার প্রধানের নারাজ হওয়া দেখে দলান্ধ বুদ্ধিজীবীরা এখন বিবৃতি যুদ্ধে নেমেছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে ১০৬ জন নোবেল বিজয়ী কখনো কোনো ব্যক্তির পক্ষে দাঁড়ানোর নজির পৃথিবীতে আছে? বিবৃতি প্রদানকারী এই নোবেল বিজয়ীদের লিস্টে ভারতের অমর্ত্য সেন ও অভিজিৎ ব্যানার্জী নাই বলে এখানে অনেকেই বলার চেষ্টা করতে থাকেন। এর পরদিনই অভিজিৎ ব্যানার্জী ও তার স্ত্রী নোবেলজয়ী এস্থার ডুফলো প্রফেসর ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি যুদ্ধে সামিল হন। এই ১০০-র বেশি নোবেল জয়ী এবং আরো ৬০ জন সাবেক ও বর্তমান ক্ষমতাধর বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব একটি মানুষের পেছনে দাঁড়িয়েছেন। এটিকে সম্মান দিন। এর অর্থ বোঝার চেষ্টা করুন। এখন রাগের বশবর্তী হয়ে কিছু করলে আরো বড় ভুল করার সম্ভবনা আছে। যার খেসারত দেশকে দিতে হতে পারে।
এক অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি অমুক জায়গায় গিয়েছেন কিনা। তমুকদিন আসলে তো নীরব থাকেন। মানে এইটাও এদের বোঝার ক্ষমতা নেই যে উনি যদি আপনাদের মতো ভাবতেন এবং করতেন তাহলে তিনিও আপনাদের মতোই হতেন। উনি তো আপনাদের মতো না। যেইসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সেইসব বিষয়কে আপনারা রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে এগুলোকে নিয়ে খেলেন। আপনারা এগুলোকে যদি রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি না করতেন তাহলে উনি হয়তো এইসব ইস্যুতে নীরব থাকতেন না। বিশ্ব পার্স্পেক্টিভে আপনাদের এইসব রাজনৈতিক পয়েন্টস স্কোরিং খেলা মাইক্রোস্কোপিক ইস্যু কারণ পৃথিবী অনেক বড়। উনিও যদি এইসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তাহলে কি প্রফেসর ইউনূস বিশ^বরেণ্য ব্যক্তিত্ব হতে পারতেন? আপনারাই তো তাকে কাঁদা ছোড়াছুড়ির মাঝে ব্যস্ত রেখে তার মেধাকে অপব্যবহার করাতেন। শুধুই কি ইউনূস? প্রফেসর রেহমান সোবহান কি এইসব মাইক্রোস্কোপিক বিষয়ে নাক গলায়? কই এতো মানুষকে দিয়ে বিবৃতি দেওয়ান কিন্তু প্রফেসর রেহমান সোবহানকে দিয়ে ইউনূসের বিপক্ষে কি বিবৃতি দেওয়াতে পেরেছেন বা পারবেন?
আসলে এই দেশে প্রফেসর ইউনূসকে প্রপারলি মাপতে জানার মতো মানুষই নেই। যারা ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন সেই ১৭০ জনকে এক পাল্লায় রেখে যারা ইউনূসের বিপক্ষে বিবৃতি দিচ্ছেন তাদের আরেক পাল্লায় রাখুন তো। এই পাল্লায় হাজার হাজার মানুষকে রাখলেও হবে না। পারলে অমর্ত্য সেন, রেহমান সোহবানকে দিয়ে বিবৃতি দেওয়ান। এই দুইজনকে দিয়ে দেওয়াতে পারলেও বুঝতাম আপনাদের কথার কিছুটা সারবত্তা আছে। যা ইউনূস বিপক্ষে দিচ্ছে এরা হলো সুবিধাভুগী। এরা সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার ভয়ে আছে। প্রফেসর ইউনূস এই দেশের জন্য অনেক করেছেন। সরকার চাইলে উনাকে দিয়ে আরো অনেক ভালো কাজ করাতে পারতেন। সেই পথে না গিয়ে উনার পেছনে লেগে কি আপনাদের কোনো লাভ হচ্ছে?
উনি বাংলাদেশের একজন বিশাল মাপের এম্বাসেডর। যারা বিদেশে থাকে তারা জানে ইউনূস কেমন? প্রফেসর ইউনূসকে কি শুধু আমেরিকা ঘরানার দেশগুলোই শ্রদ্ধা করে? চীন করে না? ভারত করে না? জাপান করে না? দক্ষিণ আফ্রিকা করে না? নোবেল পুরস্কার পাওয়ার এতো বছর পরেও দ্বিতীয় কোনো আরেক নোবেল বিজয়ী আছেন যিনি এখনো সমান জনপ্রিয়। হয়তো ভবিষ্যতে উনার নতুন তত্ত¡ সামাজিক ব্যবসা মডেলের জন্য আরেকটি নোবেল পুরস্কার পাবেন। শেষমেশ উনিও মানুষ। উনারও ভুল হয় এবং ভুল আছে। এই দেশে উনার চেয়ে অনেক বেশি ভুল করা, অনেক বেশি দুর্নীতি করা মানুষের কী অভাব আছে? উনি তো দেশ থেকে অর্থ পাচার করে নিয়ে যান না। উনি বরং বিদেশ থেকে ডলার আনেন। অঢ়ঢ়ৎবপরধঃব করেন। তাতো করেনই না উল্টো হেনস্থা আর অপমানে জর্জরিত করছেন। এতে কী বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সম্মান বাড়ছে?
অনেকেই বলেন, বেলারুশের নোবেল জয়ীর বিরুদ্ধে বেলারুশ সরকার মামলা করছে কই তার পক্ষেতো কেউ কোনো বিবৃতি দেয় না? বা বলা হয় নোবেল জয়ী হওয়া সত্তে¡ও বেলারুশে তো তার বিপক্ষে মামলা চলছে? এখানেই তো ইউনূসের বিশেষত্ব। বুঝতে হবে এতো মানুষ কেন ইউনূসের পক্ষে দাঁড়ালো? আর নোবেল জয়ীদের পেছনে লেগেছে কোন কোন দেশ? চীন, বেলারুশ, রাশিয়া প্রভৃতি দেশ। এগুলো কি খুব ভালো দেশের উদাহরণ? প্রফেসর ইউনূসের বিপক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে সরকার আমেরিকার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। এটা ভয়ানক। বিশ্বে আমেরিকা এখনো একমাত্র মোড়ল। এদের ক্ষেপিয়ে তুললে আমাদের অর্থনীতিতে ধস নামবে। পশ্চিমা দেশ বিশেষ করে আমেরিকা ছাড়া পৃথিবীর আর কোন দেশ ইমিগ্রান্টসদের প্রতি এতো উদার? রাশিয়া ইমিগ্রেন্টস নেয়? সৌদি আরব নেয়? চীন নেয়?
এই যে রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে আছে এদের সবচেয়ে বেশি সহায়তা কে দিচ্ছে? চীন, সৌদি, রাশিয়া, ভারত? আবারও সেই পশ্চিমারাই। আমেরিকা যদি রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়, তখন টের পাওয়া যাবে কত ধানে কত চাউল। জাতিসংঘে কে বেশি অনুদান দেয়? সেটাও আমেরিকা। ভিভি, ওপি১ ইত্যাদি নানা প্রোগ্রামে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে বৈধ উপায়েও ইমিগ্রান্টস নেয় আমেরিকাই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পৃথিবীর যে এই বিশাল অগ্রগতি এর পেছনেও আমেরিকা। আমেরিকা শিক্ষা ও গবেষণায় বিশাল ব্যয় করে বলেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এই বিশাল অগ্রগতি। তাদের দ্বারা তৈরি অগ্রগতির একটা স্পিলওভার ইফেক্ট দিয়ে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটেছে। আমাদের দেশের মানুষদের জীবন মানের যেই উন্নয়ন এইটা যতনা আমাদের সরকারের কৃতিত্ব তার চেয়ে বেশি হলো স্পিলওভার ইফেক্ট।
লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
