
ব্রিকস মাধ্যাকর্ষণ পরিবর্তনের বৈশি^ক কেন্দ্র
বিজয় প্রসাদ
জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলনের শেষ দিনে, পাঁচটি প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্র, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা – ছয়টি নতুন সদস্যকে স্বাগত জানিয়েছে, আর্জেন্টিনা, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। ব্রিকস অংশীদারিত্ব এখন বিশ্বের জনসংখ্যার ৪৭.৩ শতাংশকে অন্তর্ভুক্ত করে, একটি সম্মিলিত বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদন ক্রয় ক্ষমতার সমতা বা পিপিপির ৩৬.৪ শতাংশ। তুলনায়, যদিও এ৭ রাজ্যগুলো (কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ, তাদের বৈশ্বিক জিডিপিতে – পিপিপি অনুসারে – প্রতি শতাংশে ৩০.৪ শতক। ২০২১ সালে যে দেশগুলো আজ স¤প্রসারিত ব্রিকস গঠন করেছে তারা বিশ্বব্যাপী শিল্প উৎপাদনের ৩৮.৩ শতাংশ ছিল যেখানে তাদের এ৭ সমকক্ষগুলো ৩০.৫ শতাংশ ছিল। ফসল উৎপাদন এবং ধাতু উৎপাদনের মোট আয়তন সহ সমস্ত সূচকগুলো এই নতুন গ্রæপিংয়ের অপরিমেয় শক্তি দেখায়। সেলসো আমোরিম, ব্রাজিল সরকারের উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে তার প্রাক্তন মেয়াদে ব্রিকসের অন্যতম স্থপতি, নতুন উন্নয়ন সম্পর্কে বলেছিলেন যে ‘বিশ্ব আর এ৭ দ্বারা পরিচালিত হতে পারে না।’ অবশ্যই ব্রিকস দেশগুলো, তাদের সমস্ত অভ্যন্তরীণ স্তরবিন্যাস এবং চ্যালেঞ্জগুলোর জন্য, এখন এ৭ এর তুলনায় বিশ্বব্যাপী জিডিপির একটি বৃহত্তর অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, যা বিশ্বের নির্বাহী সংস্থা হিসাবে আচরণ করে চলেছে। ৪০ টিরও বেশি দেশ ব্রিকস-এ যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যদিও মাত্র ২৩টি দক্ষিণ আফ্রিকার বৈঠকের আগে সদস্যতার জন্য আবেদন করেছিল (পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন, বা ওপেকের ১৩টি দেশের মধ্যে সাতটি সহ)।
ইন্দোনেশিয়া, পিপিপি দ্বারা জিডিপির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ, শেষ মুহুর্তে ব্রিকসে তার আবেদন প্রত্যাহার করে তবে বলেছে যে এটি পরে যোগদানের বিষয়ে বিবেচনা করবে। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি জোকো উইডোডোর মন্তব্য শীর্ষ সম্মেলনের মেজাজ প্রতিফলিত করে, ‘আমাদের অবশ্যই বাণিজ্য বৈষম্য প্রত্যাখ্যান করতে হবে। শিল্প প্রবাহে বাধা দেওয়া উচিত নয়। আমাদের সকলকে সমান এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সহযোগিতার কথা চালিয়ে যেতে হবে।’ ব্রিকস নতুন আঞ্চলিক গঠন থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করে না যার লক্ষ্য পশ্চিমের দখলের বাইরে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যেমন লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান রাজ্যের স¤প্রদায় এবং সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা। পরিবর্তে ব্রিকস সদস্যপদ এই আঞ্চলিক ফোরামের মধ্যে যারা ইতিমধ্যেই রয়েছে তাদের জন্য আঞ্চলিকতা বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। আন্তঃআঞ্চলিক সংস্থাগুলোর উভয় সেটই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দ্বারা সমর্থিত ঐতিহাসিক জোয়ারের দিকে ঝুঁকছে, ট্রাইকন্টিনেন্টাল, ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল রিসার্চ ব্যাপকভাবে নির্ভরযোগ্য গেøাবাল ডাটাবেজ ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করেছে।
পিপিপির তথ্য অনুযায়ী বিশ্ব জিডিপির গেøাবাল নর্থের ১৯৯৩ সালে ৫৭.৩ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে ৪০.৬ শতাংশে নেমে আসে, মার্কিন ১৯.৭ শতাংশ থেকে মাত্র ১৫.৬ শতাংশে নেমে যায়। ২০২২ সালে পিপিপি-তে চীন ছাড়া বিশ্বব্যাপী দক্ষিণের জিডিপি ছিল বৈশ্বিক উত্তরের তুলনায় বেশি। পশ্চিম সম্ভবত তার দ্রæত আপেক্ষিক অর্থনৈতিক পতনের কারণে চীনের মতো উদীয়মান রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে একটি নতুন একটি যুদ্ধ চালিয়ে তার আধিপত্য বজায় রাখতে লড়াই করছে। সম্ভবত পশ্চিমা শক্তিগুলোর জাতিগত, রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনার একক সর্বোত্তম প্রমাণ উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সা¤প্রতিক ঘোষণা দ্বারা সংক্ষিপ্ত করা যেতে পারে। ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ক্ষতিপূরণ দিতে রাশিয়া তার কোটা অতিক্রম করায় এই বছর তেলের পরিমাণ নিয়ে রাশিয়া ও সৌদি আরবের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। এখন এই দুই দেশের আরেকটি ফোরাম থাকবে জ্বালানি শক্তির উপর ওপেক-এর বাইরে একটি সাধারণ এজেন্ডা তৈরি করতে। সৌদি আরব রেনমিনবিতে চীনের কাছে তেল বিক্রি করার পরিকল্পনা করেছে, পেট্রোডলার সিস্টেমের কাঠামোকে দুর্বল করে।
চীনের অন্য দুটি প্রধান তেল সরবরাহকারী ইরাক এবং রাশিয়া ইতিমধ্যেই আরএমবিতে অর্থ পায়। জাতিসংঘের সনদের প্রতিরক্ষায় বন্ধুদের গ্রæপ ২০১৯ থেকে ভেনিজুয়েলার উদ্যোগ – আলজেরিয়া থেকে জিম্বাবুয়ে পর্যন্ত অবৈধ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হওয়া ২০টি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রকে একত্রিত করেছে। এই রাজ্যগুলোর মধ্যে অনেকগুলো আমন্ত্রিত হিসাবে ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল এবং পূর্ণ সদস্য হিসাবে স¤প্রসারিত ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহী। আমরা বিপ্লবের সময়ে বাস করছি না। সমাজতন্ত্রীরা সর্বদা গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ধারাকে এগিয়ে নিতে চায়। ইতিহাসে প্রায়শই ঘটে থাকে, একটি মৃত সাম্রাজ্যের ক্রিয়াকলাপগুলো তার শিকারদের জন্য নতুন বিকল্পগুলো সন্ধান করার জন্য সাধারণ ভিত্তি তৈরি করে, সেগুলো যতই ভ্রূণ এবং পরস্পরবিরোধী হোক না কেন। ব্রিকসের স¤প্রসারণের জন্য সমর্থনের বৈচিত্র্য সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক আধিপত্যের ক্রমবর্ধমান ক্ষতির ইঙ্গিত।
বিজয় প্রসাদÑ একজন ভারতীয় ইতিহাসবিদ সম্পাদক এবং সাংবাদিক। তিনি গেøাবাট্রোটার-এর একজন রাইটিং ফেলো এবং প্রধান সংবাদদাতা। তিনি লেফটওয়ার্ড বুকস এর সম্পাদক এবং ট্রাইকন্টিনেন্টাল ও ইনষ্টিটিউট ফর সোশ্যাল রিসার্চ-এর পরিচালক।
সূত্র : কনসোর্টিয়াম নিউজ। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ
