
শ্রীলঙ্কা কীভাবে এতো দ্রæত বাংলাদেশের ঋণ শোধ করছে? সংকট উত্তরণে কী করছে বাংলাদেশ?

গোলাম মোর্তোজা
হঠাৎ করেই আমরা জানতে পারলাম, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ধসে পরেছে। বাংলাদেশ থেকে তারা ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। সেই ঋণ আদৌ শোধ করতে পারবে কিনা দেউলিয়া হয়ে যাওয়া অর্থনীতির দেশ শ্রীলঙ্কা; সেটা নিয়ে দেশে আলোচনাও হলো। তারপর আবার হঠাৎ করে জানলাম, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিছুদিন আগে তারা বাংলাদেশের ৫০ মিলিয়ন ডলার শোধ করেছে। তার অল্প কয়েকদিনের মধ্যে আরও ১৫০ মিলিয়ন ডলার শোধ করেছে। এখন মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ থাকলো বাংলাদেশের কাছে। এই যে এতো দ্রæত শ্রীলঙ্কা তার অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করলো, এর তাৎপর্য কী। এ বিষয়ে তিনজন বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন, যা ‘দ্যা ডেইলি স্টার বাংলায়’ প্রকাশিত হয়েছে। তারা হলেন অধ্যাপক মইনুল ইসলাম (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), আহসান এইচ মনসুর (অর্থনীতিবিদ), অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়)। তারা যা বলার চেষ্টা করেছেন তাহলো দুর্নীতির জায়গা থেকে তারা বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে, গণতান্ত্রিক ভিত্তি আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কাজ করতে দেওয়া হয়েছে, গণতান্ত্রিক অবস্থা থাকার কারণে শ্রীলঙ্কাণ রাজা পাকশের সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা গিয়েছে, কোভিডের পর পর্যটন ব্যবস্থা ফিরে এসেছেÑ এই সকল কারণে যে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থা ঘুরে গেলো, এর মধ্যে মূল যে বক্তব্য তাহলো শ্রীলঙ্কার ঘুরে দাঁড়ানোর ‘গণতান্ত্রিক কৌশল’।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির তুলনা করা খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়। কারণ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড়, বাংলাদেশের অর্থনীতির নানাবিধ সেক্টর থেকে যে অর্থ আসে সেটা শ্রীলঙ্কার চেয়ে বড় এবং শক্তিশালী। তাই শ্রীলঙ্কা ধসে গিয়েছে বলে বাংলাদেশ ধসে যাবে এই আলোচনা করা যাবে না। কিন্তু তুলনামূলকভাবে যে আলোচনাটি সামনে আসে তাহলো শ্রীলঙ্কা যে সঙ্কটে পড়ে এতো দ্রæত ঘুড়ে দাঁড়ালো, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নানা ধরনের সঙ্কট আছে সেই সঙ্কট শ্রীলঙ্কার মতো নয়। সঙ্কট শ্রীলঙ্কার মতো না হলেও যেই সঙ্কট আছে সেই সঙ্কট থেকে বাংলাদেশ উদ্ধারের চেষ্টা করছে কিনা সেই কারণেই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কিছুটা তুলনামূলক আলোচনা হচ্ছে। প্রথমত শ্রীলঙ্কা যখন সঙ্কটে পড়লো তখন প্রধানতম যে ঘটনাটি ঘটলো তাহলো রাজা পাকশের সরকার অর্থনীতিতে যে উচ্চভিলাসী মেগা প্রকল্প নিয়েছিলো শ্রীলঙ্কা সঙ্কটে পড়ার পর সেখানকার জনগণ বুঝতে পারলো যে এই উচ্চভিলাসী মেগা প্রকল্পগুলো তাদের দেশের স্বার্থে অনুক‚ল নয়। এটাকে তারা চ্যালেঞ্জ করলো। শ্রীলঙ্কার গণতান্ত্রিক একটা কাঠামো ছিলো, শ্রীলঙ্কার প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী ছিল। যেহেতু গণতান্ত্রিক একটা কাঠামো ছিলো, প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী ছিল সেজন্য রাজা পাকশেকে চ্যালেঞ্জ করা হলো। সেই চ্যালেঞ্জের মুখে রাজা পাকশের সরকারের পতন হলো। অর্থাৎ একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ ধসে যাওয়া আগে শ্রীলঙ্কানরা গণতান্ত্রিক কাঠামো দিয়ে, প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে রাজা পাকশের সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিলো।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আরেকটি সরকার ক্ষমতায় এলো। সেই সরকার ক্ষমতায় এসে কয়েকটি কাজ করলো তার মধ্যে একটিতে তারা প্রকৃতিগতভাবে উপকৃত হলো কারণ শ্রীলঙ্কা একটি পর্যটন নির্ভর দেশ। সারা পৃথিবী থেকে বিপুল সংখ্যক পর্যটক শ্রীলঙ্কাতে আসে। তাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম একটি খাত পর্যটন খাত। কোভিডের পর তাদের পর্যটন খাতে অর্থ আসার প্রক্রিয়া আবার শুরু হলো। বিশেষজ্ঞদের মতে তাদের উচ্চাভিলাসী যে প্রকল্পগুলো ছিল, বৈদেশিক মুদ্রার বিপুল পরিমাণ যে ঋণ ছিলো সেই জায়গায় তারা লাগাম টেনে ধরলো। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের বিষয়টি এমন একটি জায়গাতে গিয়েছিলো যে পতনের আগে দিয়ে শ্রীলঙ্কার পার্লমেন্টে অর্থমন্ত্রীর কাছে যখন বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা জানতে চেয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের লোনের পরিমাণ কত বিলিয়ন ডলার সে সময়ের শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে সঠিক তথ্যও বলতে পারেনি। এতেই বোঝা যায় কী পরিমাণ অগোছালো অবস্থা শ্রীলঙ্কার ছিলো। সেই জায়গা থেকে নতুন সরকার এসে এই উচ্চাভিলাসী প্রকল্পগুলোর লাগাম টেনে ধরে।
বৈদেশিক ঋণের জায়গাটিতে অপচয় যাতে রোধ করা যায় সেই জায়গায় তারা উদ্যোগ নেয়। এর একটি প্রধান কাজ হলো তাদের প্রতিটি মন্ত্রণালয় ধরে ৬ শতাংশ হারে খরচ কমায়। কৃচ্ছ্রতা সাধন আমাদের কাছে একটি শব্দ আছে, যা আমরা জানি। কিন্তু ব্যবহার করি না। কিন্তু শ্রীলঙ্কা সত্যি সত্যি তাদের খরচ ৬ শতাংশ হারে কমিয়ে আনে। চীন থেকে ঋণ নিয়ে সমুদ্র ভরাট করে শহর তৈরি করা, বিমানবন্দর তৈরি করা, বড় বড় ফ্লাইওভার তৈরি করা, চার-ছয় লেনের রাস্তা তৈরি করা এসব কিছু থেকে তারা পিছিয়ে এসেছে। এসব জায়গা থেকে সরে এসে শ্রীলঙ্কার যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন সরকার এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য, সঙ্কট কাটানের জন্য, দেউলিয়া অবস্থা থেকে যাতে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা যায়, সে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে অর্থনীততে নিজস্ব নীতি প্রণোয়ন করে। অর্থনীতিবিদরা বা রাজনীতিবিদরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হস্তক্ষেপ করা থেকে দূরে থাকে। যেটা রাজা পাকশের সময় প্রবলভাবে ছিলো। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাজা পাকশের সরকার একটি তুঘলকী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সেটি হলো তারা রাসায়নিক সার ব্যবহার করবে না, রাসায়নিক সার আমদানি করবে না তারা অর্গানিক খাদ্য উৎপাদন করবে জৈব সার ব্যবহার করে। এই নীতি নেওয়ার কারণে তাদের উৎপাদন অবিশ্বাস্য রকমভাবে কমে যায়। নতুন সরকার এসে আবার সার, বীজ আমদানি করে আবার উচ্চ ফলনশীল ধান থেকে শুরু করে সবকিছু তারা আবার উৎপাদন শুরু করে। যে কারণে এই দেড়-দুই বছরে তাদের উৎপাদন আবার একটি স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে এসেছে। তার মানে আমদানির উপর বিপুল যে ব্যয় হতো, তা কমে গেছে।
সর্বোপরি, শ্রীলঙ্কানদের অর্থনৈতিক কাঠামো খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তাদের গণতান্ত্রিক কাঠামো ঠিক ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কা প্রায় শতভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দেশ। শ্রীলঙ্কাতে যারা গিয়েছেন তারা দেখবেন শ্রীলঙ্কার মানুষের আচার-আচরণ, রাস্তা-ঘাট সবকিছুর মধ্যে একটি রুচিসম্মত, নিয়মতান্ত্রিক বিষয় আছে। এই দেশে রাজা পাকশের সরকার তুগলোকি করলেও তাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়নি। সে কারণেই শ্রীলঙ্কার জনগণ, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো রাজা পাকশের সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে পেরেছে, ক্ষমতার পতন ঘটাতে পেরেছে। যে কারণে শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধ করলো, আইএমএফ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার লোন পেলো, চীনের ঋণের ফাঁদ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে ঋণ দিয়ে তাদের যে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি করিয়েছিলো সেটা তারা ঠিকমতো পরিচালনা করতে পরেনি, চীন পরিচালনা করেছে। এই সমস্ত অপরিকল্পিত ঋণের জায়গা থেকে শ্রীলঙ্কা ধীরে ধীরে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। যেহেতু শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, গণতান্ত্রিক কাঠামো আছে, যেহেতু ক্ষমতার পরিবর্তন গণতান্ত্রিক উপায়ে করা যায় সেজন্য রাজা পাকশের পরে এখন যারা এসেছেন তারাও জানেন তারা যদি ঠিক মতো কাজ না করে তাদেরও পতন অনিবার্য। সেজন্য তারা এসে জনগণের মনোভাব বুঝে কাজ করছেন।
আমাদের যেই তিনজন অর্থনীতিবিদ মতামত দিয়েছেন সেখানে তারা বলছেন বাংলাদেশ যেসমস্ত সঙ্কটে আছে সেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে না। ঋণ খেলাপি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে না, টাকা পাচার কমানোর চেষ্টা করছে না, অর্থনীতিতে যে স্থবিরতা চলছে সেটা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে না, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিক মতো কাজ করছে না। মেগা প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট হিসাব ছাড়া আমরা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। মেগা প্রকল্পগুলো আপাতদৃষ্টিতে দৃষ্টিনন্দন লাগলেও, সরকারের সাফল্য মনে হলেও, সেখান থেকে ফলাফল কেমন আসবে, ফলাফল কবে থেকে আমাদের অর্থনীতিতে যোগ হবেÑ সেই হিসাবগুলো আমরা করছি না বলে অর্থনীতিবিদরা বলছেন। আমরা মেগা প্রকল্প নিচ্ছি, সেই প্রকল্পের লাভ কীভাবে হবে, এখন বাংলাদেশের কাঁধে যেই ঋণগুলো আছে সেই ঋণগুলো কীভাবে শোধ করা হবে তা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই।
আমাদের অর্থমন্ত্রীকে কোথাও দেখা যায় না। হঠাৎ করেই সামনে আসেন তিনি। কিছুদিন আগে এসে বললেন, আমাদের অর্থনীতি আর কতো ভালো হবে। জিনিসপত্রের দাম থেকে শুরু করে কোনো কিছুই তাকে ভাবিত করে না। তার বিবেচনায় অর্থনীতি খুব ভালো আছে, খেলাপি ঋণ কোনো সমস্যা না, টাকা পাচার কোনো সমস্যা না। এই যেসব সমস্যা ইগনোর করা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সারা পৃথিবীর মানুুষ এবং অর্থনীতিবিদরা এটাকে আশঙ্কাজনক অবস্থা বলছেন। শ্রীলঙ্কান জনগণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, তাদের টাকা পাচারকারী, ঋণ খেলাপি, ঋণের পরিমাণ বাংলাদেশ থেকে অনেক কম। তার পরিপ্রেক্ষিতেও বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার তুলনা করা হচ্ছে না কিন্তু এই তুলনাটা করা হচ্ছে যে শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে যেসমস্ত নীতি নিয়েছে বাংলাদেশ এখন যে সঙ্কটে আছে বাংলাদেশ সেই সঙ্কটগুলোকে আমলে নিচ্ছে না। তারা সেই সঙ্কটগুলো থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছে না, সেই সঙ্কটগুলোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছে না যে কারণে বাংলাদেশেকে নিয়ে একটা আশঙ্কা করা হচ্ছে যদি বাংলাদেশে কোনো বড় সঙ্কট হয় তাহলে বাংলাদেশে আদৌও সামাল দিতে পারবে কিনা সেই আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে গেছে বা হয়ে যাবে যারা বলছেন তারা একটু বোঝার চেষ্টা করুন শ্রীলঙ্কা বিপদে পরে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তা থেকে মুক্ত হচ্ছে। আমরা বিপদের সম্মুখীন হতে যাচ্ছি বলে মনে করছি। কিন্তু সেই বিপদ থেকে উত্তরণের জন্য আমরা কিছু করছি না। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কার জায়গা মূলত এটাই। পরিচিতি : সিনিয়র সাংবাদিক। ফেসবুক থেকে
সূত্র: ‘গোলাম মোর্তোজা’ ফেসবুক পেজ। শ্রæতিলিখন: জান্নাতুল ফেরদৌস
