
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক ব্যবস্থার কথা বিশ^বাসী জানলো না কেন?

সুষুপ্ত পাঠক
ক্ষুদ্রঋণ নামের যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা আজকে আমরা দেখি, ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসরে সেটাই ‘পতিসর কৃষি সমবায় ব্যাংক’ নামে প্রতিষ্ঠা করেন। জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের এই চিন্তার জন্য ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ড. ইউনূস তার নোবেল বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথের পতিসরের কৃষি ব্যাংকের উদাহরণ দেননি। তিনি বলতে পারতেন, প্রায় দেড়শ বছর আগে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বাংলা ভাষার মহান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালু করেছিলেন, আর সেটাই ছিলো ক্ষুদ্রঋণের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা। ইউনূস সাহেব পতিসরের কৃষি ব্যাংকের কথা জানতেন। তার মাথায় ক্ষুদ্রঋণের আইডিয়া আসতে এসব তথ্য যে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলো বলাই বাহুল্য। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই ইউনূস সাহেব রবীন্দ্রনাথের কৃষি ব্যাংককে এড়িয়ে গেছেন। কারণ ড. ইউনূসও তো একজন ‘মুসলিম লীগার’!
বিস্মিত হতে হয়, রবীন্দ্রনাথের এই ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক ব্যবস্থার কথা পৃথিবীবাসী জানলো না কেন? তাঁকে পূর্ববঙ্গের ‘অত্যাচারী জমিদার’ সাজানোর কমিউনিস্টদের যে ন্যারেটিভ তা রবীন্দ্রনাথের কৃষি ভাবনা, গরিব কৃষকদের নিয়ে মহাজনী সুদ কার্যক্রম থেকে তাদের রক্ষার সংগ্রামকে ঢেকে দিয়েছে। কেউ কি আজ জানে রবীন্দ্রনাথের সেই ব্যাংক ২৫ বছর পর্যন্ত টিকে ছিলো? তুমুল জনপ্রিয় ছিলো কৃষকদের কাছে সেই ব্যাংক। মহাজনের সুদ নিয়ে মাথা বিক্রি করে দেওয়া নয়, পতিসর কৃষি সমবায় ব্যাংক ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে পতিসরের মতো একটা অখ্যাত গ্রামে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছিলো। রবীন্দ্রনাথ এই ব্যাংককে তাঁর সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছিলেন। ধার দেনা যা করার করেছিলেন। ১৯১৩ সালে নোবেল পাওয়া অর্থের ১ লাখ ৭৮ হাজার টাকার পুরোটা ব্যাংকে দান করে দেন। কতোখানি গভীর অনুরাগ ভালোবাসা থাকলে মানুষ নিজের টাকা, সেকালে কী বিপুল পরিমাণ এই টাকা স্রেফ জলে ঢেলে দেন চিন্তা করুন। পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কৃষক প্রজাদের ৭০ ভাগই মুসলমান। এই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের পুরোটাই তারা সুফল পেয়েছে। ২৫ বছর ব্যাংক লোকসান গুনেছে। রবীন্দ্রনাথ কবি, ব্যবসায়ী নন। ব্যবসায়ী হলে কঠোর হতে বাধ্য হতেন দুটো কারণে। কঠোর না হলে ব্যাংক টিকবে না, ব্যাংক না টিকলে কৃষকদের ঋণ দেয়া যাবে না। ফলাফল রবীন্দ্রনাথের ব্যাংক লোকসান নিতে নিতে ২৫ বছরের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়।
ড. ইউনূস পুরো মাত্রায় ব্যবসায়ী। ফলে তার ব্যাংক সুদ আদায়ে কোন ছাড় দেয়নি। সুদের টাকার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক কঠোর হয়েছে। এসব নিয়ে বুক ভাসিয়ে দিয়েছে যারা তারা কোনোদিন ভেবে দেখেছেÑ জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণ এইসব ব্যাংক ছাড়া আর কে দেবে? মূলধারার ব্যাংক বানানোই হয় হাজার কোটি টাকা ঋণ লোপাট করার জন্য। তারা কেউ কৃষকদের ঋণ দেবে? ড. ইউনূস সুদ খেলে তাই আপনার সমস্যা কী? বাংলাদেশ সরকার সুদ খায় না? আপনি ব্যাংকের দেওয়া সুদ খান না? সুদ খারাপ জিনিস? মহাজনী সুদ ব্যবস্থায় বাংলার কৃষকের দুরবস্থা দেখে সহ্য হয়নি ‘জমিদার’ রবীন্দ্রনাথের। খুলে দিলেন পৃথিবীর প্রথম ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক। আজ রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে মুসলিম লীগাররা তাঁকেও ‘সুদখোর’ বলতে দ্বিধা করতো না। মুসলিম লীগার সে যতো লিবারাল হোক, কমিউনিস্ট, বা ধর্মনিরপেক্ষ সাজুক, ইসলামের সুদ মদ বিরোধিতা তার জিনে বসে গেছে। কোনো মানুষের চরিত্র হনন করতে এখনো এদেশে তার বাড়ি থেকে মদ উদ্ধার করে জনসাধারণের কাছে তাকে খারাপ প্রমাণ করানো হয়। কেউ সুদ নিলে তাকে মহাপাপিষ্ঠ হিসেবে প্রমাণ করানো হয়। স্বাধীনতার পর ঘটা করে মদ জুয়া নিষিদ্ধ করা ছিলো মুসলিম লীগের মডারেট অ্যাক্টিভিটি…।
ড. ইউনূস যতো বড় নোবেল লরিয়েট হন, অন্যায় করলে তাকে জেল জরিমানা পেতেই হবে। ইউনূসের বিরুদ্ধে আদালতের এখন যে সক্রিয়তা সেটা দেখে তবু হাসি পায় কেন? কারণ আমরা দেখি, ড. ইউনূস এমন সব লোকদের তুলনায় নেহাতই নিষ্পাপ যারা টাকার পাহাড় মেরে দিয়ে শিস দিতে দিতে বিমানবন্দর দিয়ে সরকারি ভিআইপি মর্যাদায় চলে গেছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার আদালত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ইউনূস রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেন কিনা, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন কিনা- সেসব বিষয়ে নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে চাক্ষুষ প্রমাণপত্র আছে। যদিও সেসব আপনারা কখনোই দেখান না। তবু সেসব মেনে নিতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তার বদলে তাকে ‘সুদখোর’ বলাটার সময় আপনার মুখের রেখা যেভাবে জেগে উঠে তাতে আপনার পাক্কা মুসলিম লীগার অবস্থানটা ফুটে উঠে। নিজেরা সুদ খেয়ে, মাথার পিছন দিয়ে ঘুরিয়ে, সুদের আগে ‘ইসলামী’ শব্দ বসিয়ে সুদ খেয়ে আরেকজনকে সুদখোর বলাটা ভÐামি। সুদ ছাড়া যে অর্থনীতি অচল সেটি সপ্তম শতাব্দীর খেজুরবাগানে খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়া বেদুঈন যুদ্ধবাজ একটা গোত্র কী করে বুঝবে? তারা তো কৃষিকাজ জানতো না। পশু শিকার ও একে অন্যের তাঁবুতে লুটপাট চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। তাদের কাছে পতিসরের সমবায় কৃষ্টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকেও সুদী কার্যক্রম বলে ঘৃণা হতে পারে, স্বাভাবিক।
ফেসবুক থেকে
