
ডিমের বাজার নিখুঁত প্রতিযোগিতার পাঠ্যপুস্তকের উদাহরণ

ড. আসরার চৌধুরী
ডিমের বাজার নিখুঁত প্রতিযোগিতার পাঠ্যপুস্তকের উদাহরণ। অনেক বিক্রেতা এবং অনেক ক্রেতা আছে। সব বিক্রেতা এবং ক্রেতা ডিম একই হিসাবে দেখেন। পার্থক্য শুধুমাত্র ডিম হয় সাদা বা বাদামী। কোনও ডিমের খামার এবং কোনও চূড়ান্ত ভোক্তা একটি নির্দিষ্ট দিনে দামকে প্রভাবিত করতে পারে না। ডিমের দাম সরবরাহ এবং চাহিদার উপর নির্ধারিত হবে এখানে কারও ক্ষমতা নেই কিছু করার। ডিমের বাজারের মতো অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দাম স্থিতিশীল থাকবে বলে আশা করা যায়। এটি উঠতে পারে সময়ের সাথে সাথে। বাংলাদেশে ডিমের দামের সা¤প্রতিক অস্থিরতা থেকে বোঝা যায় যে ডিমের দামের ক্ষেত্রে এক বা একাধিক জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ডেটা একপাশে রেখে আমরা দুটি সহজ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারি। ডিমের দাম বাড়ার কারণ কী? এই বৃদ্ধির পর কি হবে? এটি এমন একটি শিল্পকে বুঝতে সাহায্য করবে যা খুব দীর্ঘ সময়ের জন্য শুরু হয়েছে।
প্রধান কারণ ফিডের মূল্য : ডিম উৎপাদনের প্রধান খরচের উপাদান হল খাদ্য। এটি ডিম উৎপাদনের মোট খরচের দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত হতে পারে। এর মধ্যে ভুট্টা ও সয়াবিন প্রধান উপাদান। বাংলাদেশের পর্যাপ্ত ফিড মিলের সক্ষমতা রয়েছে। পোল্ট্রি শিল্প দেশের ফিড মিল উৎপাদনের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ খরচ করে। তবে ভুট্টা এবং সয়াবিনের দাম বাড়লে অনেক ছোট ফিড মিল বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে ফিডের দাম বেড়ে যায়। লোকসানে বিক্রি করায় অনেক ছোট খামারি কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। খামারের আকার ছোট হওয়ায় তারা সময়ের সাথে লোকসানে টিকতে পারেনি। ডলারের বিনিময় হারে অস্থিরতার কারণে ক্রেডিট লেটার (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে আরও চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। এতি সরবরাহের ঘাটতি দেখা দেয় ফলে খাদ্য ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। কোভিড মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে আমদানি করে সেসব দেশে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদানের বৈশ্বিক সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটায়। কিছু দেশ যারা বাংলাদেশে এসব উপাদান রপ্তানি করে তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে ব্রয়লার ফিডের বিক্রয়মূল্য এবং এর উৎপাদন খরচের মধ্যে ব্যবধান ফিড শিল্পের জন্য টিকিয়ে রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডিমের দাম বেশি মানে রাজস্ব কম : বাংলাদেশে নি¤œ আয়ের পরিবারের প্রোটিনের প্রধান উৎস ডিম। ডিমের চাহিদা দামের সাথে উঠানামা করে। দাম পাঁচ শতাংশ বাড়লে চাহিদা কমবে পাঁচ শতাংশের বেশি। পরিবারগুলো হয় কম ডিম খাবে বা তারা একটি বিকল্প উৎস সন্ধান করবে। এখানেই গল্পটা এলোমেলো হয়ে যায়। বাংলাদেশে, স্বল্প আয়ের পরিবারে প্রোটিনের উৎস হিসেবে ডিমের নিকটতম বিকল্প হল তেলাপিয়া এবং পাঙ্গাসের মতো মাছ এবং মুরগিতে ব্রয়লার মুরগি। গত কয়েক বছরে এই তিনটি খাবারেরই দাম বেড়েছে। কেন? এই বাজারগুলো আন্তঃসংযুক্ত কারণ হলো ফিড। কম ডিম বিক্রির ফলে খামারের আয় কম হয়েছে। এটি ছোট খামারগুলোতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে যেগুলো অল্প লাভের উপর টিকে আছে। ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশে ডিমের খামারগুলোকে দুটি ধাক্কা মোকাবেলা করতে হয়েছে, প্রথমটি কোভিডের কারণে এবং দ্বিতীয়টি খাদ্য, ওষুধ এবং অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধির কারণে। লোকসান সইতে না পারায় অনেক ডিমের খামার বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
কিভাবে ডিম ফার্ম থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছে : দেশে ডিমের খামারগুলো শীর্ষ কয়েকটি বড় কর্পোরেট খামার থেকে শুরু করে মাঝারি এবং ছোট খামারের চেইন পর্যন্ত কর্পোরেট খামারগুলো সাধারণত তাদের ডিম নিলাম করে এবং পাইকারী বিক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করে বা শহরে বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে বিক্রি করে। ছোট ডিমের খামারগুলো একজন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে যিনি একটি এলাকার বেশ কয়েকটি খামার থেকে ডিম সংগ্রহ করেন। ব্যবসায়ী ডিমগুলো ঢাকার তেজগাঁওয়ের মতো শহুরে বাজারে নিয়ে যায়, যেখানে সে সেগুলো দ্বিতীয় ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে। দ্বিতীয় ব্যবসায়ী খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। সুতরাং ক্ষুদ্র কৃষক এবং ভোক্তার মধ্যে অন্তত দুইটি মধ্যস্বত্বভোগী আছে। এ বছর ডিমের দাম বাড়ার পেছনে দুটি কারণ ভ‚মিকা রেখেছে। এই বছর গ্রীষ্মকালে অতিরিক্ত গরমের কারণে মুরগির খেতে অসুবিধা হচ্ছে। এতে ডিম উৎপাদন কমে যায়। এ বছর বর্ষাকালে অনেক ছোট খামার তাদের ডিম পাইকারদের কাছে সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সরবরাহ কমে গেছে তাই সস্তা মাছ তেলাপিয়া ও পাঙ্গাসের দাম বেড়েছে। স্বল্প আয়ের পরিবারগুলো বিকল্প হিসাবে ডিমে স্যুইচ করার চেষ্টা করেছিল। সরবরাহ স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকায় ডিমের চাহিদা বেড়েছে। এই ধাক্কায় চড়া দামে ডিম বিক্রি হয়। একটি সমস্যা আছে বাংলাদেশের চূড়ান্ত ভোক্তাদের কাছে যে ডিম পৌঁছেছে তা সবই স্থানীয় ডিম। যখন সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়, তখন সরকার ডিম আমদানি করতে পারে না কারণ ডিম আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এটি দেশীয় শিল্পকে রক্ষা এবং উৎসাহিত করার জন্য। এটি একটি স্থিতাবস্থার দিকে পরিচালিত করেছে যেখানে একটি উন্মুক্ত বাজার নীতি বিপরীতমুখী হতে পারে।
আমরা আসলে কতটা জানি : প্রতিযোগিতামূলক বাজারের সৌন্দর্য হল কোন বিক্রেতা বা ক্রেতা শিল্পকে প্রভাবিত করতে পারে না। যাইহোক যেমন আমরা দেখেছি ডিম শিল্পে সরবরাহ ঘাটতি ঘটতে পারে। এর মধ্যে কিছু ধাক্কা কাঠামোগত এবং কিছু ঋতুগত। প্রতিযোগিতামূলক বাজারের বৈশিষ্ট্য হলো, এই সরবরাহের ঘাটতির সময়, সরবরাহ চেইন অল্প সময়ের জন্য ব্যাহত হয়। এই সময়ের মধ্যে সুবিধাবাদিদের এক চতুর্থাংশের সুযোগ তৈরি হয়। যাইহোক ডিম শিল্পের একটি বিস্তৃত সমীক্ষার অনুপস্থিতিতে এটি যেকোনো প্রান্তিকে নির্দেশ করা বা মতামত দেওয়া বিভ্রান্তিকর হতে পারে। দেশের ডিম শিল্পের একটি বিস্তৃত জরিপ পরিচালনা করার জন্য রাজ্য বিভাগ এবং মন্ত্রনালয়ের সময় এসেছে। সহজ যুক্তি হলো ডিম হল কম আয়ের পরিবারের জন্য প্রোটিনের সবচেয়ে সস্তা উৎস যাদের কাছে সহজে এর বিকল্প নেই। আমাদের জানতে হবে আমাদের ঝুড়িতে কতগুলো ডিম আছে।
ড.আসরার চৌধুরীÑ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ডেইলি স্টারের একজন কন্ট্রিবিউটর। সূত্র : ডেইলি স্টার। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ
