বাবার সম্পদ দেখে সন্তানেরা ভাবে, পড়ালেখা করে কী লাভ!
অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
সন্তানকে সুশিক্ষিত করে মানুষ না বানিয়ে সন্তানের জন্য বাড়ি-গাড়ি বানালে যেই ক্ষতি হয়, একই ক্ষতি হয় দেশের মানুষকে সুশিক্ষিত না করে তাদের জন্য অবকাঠামো বানালে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ সন্তানের প্রতি মায়া, দরদ বা ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে তাদের জন্য খেয়ে না খেয়ে গাড়ি, বাড়ি আর সম্পদ রেখে যায়। এতে কী হয়? বাবার সম্পদ দেখে ভাবে লেখাপড়া করে কী লাভ? ফলে পড়ালেখা করে মানুষ হতে চায় না। অমানুষ হওয়ার কারণে পিতামাতার রেখে যাওয়া সম্পত্তি নিয়ে ভাইয়ে-ভাইয়ে, ভাই-বোনে ঝগড়া করে। ঠিক একই কাজ হয় রাষ্ট্রীয় লেভেলে। রাষ্ট্র যারা চালায় তারা যদি দেশের নাগরিকদের জন্য সুশিক্ষায় বিনিয়োগ করে ভালো মানের মানুষ হিসাবে তৈরি না করে কেবল অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করে তাহলে এই নাগরিকরা অবকাঠামোর ব্যবহার জানবে না। যেমন বিশ্ববিদ্যালয় বানালো, ভবন বানালো কিন্তু ভালো মানের শিক্ষক নেই, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ভালো পরিবেশ নেই। এসব দালান কোঠা বানানোর কোনো অর্থ আছে? মানহীন শিক্ষায় সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিতরাতো রাজনীতি করলে খারাপ রাজনীতি করবে, চাকুরী করলে দুর্নীতি করবে ফলে দেশের বারোটা বাজবে।
আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডা জিডিপির ৪ শতাংশের উপরে শিক্ষায় ব্যয় করে আর আমরা করি ১.৭৬ শতাংশ। তারা ইতিমধ্যে প্রফেসর সালামের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স (ইতালি) এর সহযোগিতায় রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে একটি আন্তর্জাতিক ইনস্টিটিউট খুলেছে। তারা যে শিক্ষায় বিনিয়োগ করে ভালো মানুষ তৈরী করছে তার প্রতিফলন কিগালিতে পড়েছে। গত পরশু আমার কন্যা বিয়াংকার সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। ও বলছিল ওর একজন ঘনিষ্ট বন্ধু রুয়ান্ডার কিগালি শহর থেকে এসেছে। সেখানে নিয়ম করেছে যে, মাসে একটা দিন হবে শহর পরিষ্কার করার দিন। ওই দিন সব কিছু বন্ধ থাকবে। সকলে ওই দিন তাদের শহরকে পরিষ্কার করার কাজ করবে। এছাড়া যেকোনো সময় যে কেউ যদি নির্ধারিত স্থানের বাহিরে ময়লা ফেলে তার জন্য জরিমানা। এইভাবে রুয়ান্ডার রাজধানী এই কিগালি শহর আফ্রিকার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহরে পরিণত হয়েছে।
ঠিক তেমনি ভাবে ভিয়েতনামও এগিয়ে যাচ্ছে। গত ১৪ বছর যাবৎ ভিয়েতনাম শিক্ষায় জিডিপির ৪ শতাংশের উপরে বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে আর আমরা বরাদ্দ দেই ২ শতাংশের আশেপাশে। তার ফল এরা এখন পাচ্ছে। ২০০৮ সালেও যেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং ১ থেকে ১০০০ এর মধ্যে ছিল না এখন তাদের ২টি বিশ্ববিদ্যালয় ৪০০ থেকে ৫০০ এর মধ্যে। ভিয়েতনামের জনসংখ্যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। আমেরিকায় লেখাপড়া করছে এইরকম ভিয়েতনামের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৪ হাজারের বেশি যেখানে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ১২ হাজার বা তাদের অর্ধেক যদিও আমাদের জনসংখ্যা তাদের দ্বিগুন। বাহে সায়েন্সটা কী এতই কঠিন? আমার কন্যার ঘনিষ্ট এক ভিয়েতনামের। এইবার ওর কলেজে ভিয়েতনাম থেকে ৪ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১ জন। এরকম ডিস্প্যারিটি প্রায় সকল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েই। বিয়াংকা বলেছে ওদের শিক্ষার মান অনেক ভালো। এদের অধিকাংশই আসে স্কলারশিপ নিয়ে। বাংলাদেশের অধিকাংশ যারা আন্ডার গ্রাজুয়েট পড়তে যায় আসে নিজ খরচে।
তাহলে কী বুঝলাম? শিক্ষায় বিনিয়োগ করে আগে দেশের মানুষকে সত্যিকারের মানুষ বানাতে হবে। নাহলে দুর্নীতিবাজ হবে, টাকা পাচারকারী হবে, অতি চালাক হতে গিয়ে অতি মুনাফাখোর হবে। যার লক্ষণ সর্বত্র। আমরা এর চরম ভিক্টিম। পাশের দেশ কলকাতায় যেই ডাবের মূল্য ৫০ থেকে ৬০ টাকা সেটা আমাদের দেশে ২০০ টাকা। প্রত্যেকটা নিত্যপণ্যের মূল্য কলকাতায় ঢাকার চেয়ে অনেক কম। অথচ কলকাতার মানুষদের বেতন বেশি। কারণ ওখানকার মানুষ আমাদের মতো মুনাফাখোর না। তারা বুঝে সমাজ একটা কো-অপারেটিভ ফেনোমেনা। এখানে অতি চালাকি করে কেউ জয়ী হতে পারে না। অন্যদের ঠকিয়ে নিজে কখনো ভালো থাকা যায় না কারণ অন্যরা তার চেয়ে কম চালাক না। আমাদের স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোর মান দেখুন, শিক্ষার্থীদের থাকা খাওয়ার মান দেখুন, শিক্ষকদের মান দেখুন, শিক্ষকদের বেতন দেখুন তাহলেই বুঝতে পারবেন রাষ্ট্রের কত অবহেলা। ডযড় ফড় ুড়ঁ ঃযরহশ ুড়ঁ ধৎব ভড়ড়ষরহম?
লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়