
ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে

বদরুদ্দীন ওমর
নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর একটি তথ্যচিত্র প্রচারিত হওয়ার পর এই ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কর্মকাÐ এবং এক্ষেত্রে এর পরিচালক ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে অনেক ধরনের সমালোচনা শুরু হয়। এতে ইউনূসের আর্থিক অনিয়ম বিষয়ে কিছু তথ্য দেয়া হলেও গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশে দারিদ্র্য দূরীকরণের নামে কী করছে এবং এর ফলে গ্রামীণ গরিবদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি না হয়ে কিভাবে তারা অধিকতর ঋণগ্রস্ত ও দুর্দশাগ্রস্ত হচ্ছেন সে বিষয়েও অনেক তথ্য দেয়া হয়। লক্ষ্য করার বিষয়, দেশে ও বিশেষভাবে দেশের বাইরে প্রামাণ্য তথ্যচিত্রটি নিয়ে যত আলোচনা হয় সেগুলো ইউনূসের আর্থিক অনিয়মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। গ্রামীণ ব্যাংক ও তার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ ইউনূস দারিদ্র্য দূরীকরণের নামে গ্রামের গরিবদের জীবন নিয়ে কিভাবে বাণিজ্য করছেন তার ওপর প্রকৃতপক্ষে কোন আলোচনাই হয় না। পরবর্তী পর্যায়ে অবশ্য এ নিয়ে কিছু আলোচনা শুরু হয়েছে। শুধু গ্রামীণ ব্যাংকই নয়, সাধারণভাবে ক্ষুদ্রঋণ গ্রামাঞ্চলে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এ নিয়ে এখন এমনভাবে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে, যা এর আগে দেখা যায়নি। একই সঙ্গে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে ক্ষুদ্রঋণ দাতা এনজিওগুলো কিভাবে গরিবদের ব্যবহার করে, তাদের দারিদ্র্য এবং অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে বাণিজ্য করছে সেটাও আলোচিত হচ্ছে।
নরওয়ের তথ্যচিত্রটিতে আছে জোবরা গ্রামের জেরিনার কথা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এই গ্রামে ইউনূস প্রথম কাজ শুরু করেন। যে জেরিনাকে তিনি ঋণ প্রদান করেন তার দারিদ্র্য মুক্তি তো দূরের কথা, তিনি চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করে মৃত্যুবরণ করেন। তার মেয়ে এখন ভিক্ষা করে জীবনধারণ করছেন। হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে আসার সময় যশোরের যে গ্রামটিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে হিলারিকে দেখানো হয় এবং পরে হিলারি পল্লী নামে পরিচিত করা হয় সেখানকার গ্রামীণ ঋণগ্রহীতা ও মানুষের দুর্দশার চিত্রও এতে দেখানো হয়। ক্ষেত্রবিশেষে গ্রামীণ ব্যাংকসহ ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী এনজিওগুলো থেকে নেয়া ঋণ নিয়ে কেউ কেউ কিছুটা উপকৃত হলেও তাদের সংখ্যা নগণ্য। অধিকাংশই দারিদ্র্যের কারণে এই ঋণ নিতে বাধ্য হলেও তাদের অবস্থার কোন উন্নতি না হয়ে অবনতিই হয়েছে। শুধু তাই নয়, অনেকেই এই ঋণ নিয়ে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন। এই ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে ঋণের কারণে আত্মহত্যার খবরও সংবাদপত্রে প্রায়ই পাওয়া যায়। আগেকার দিনে এবং এখনও গ্রাম্য মহাজনদের থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নেয়া সত্তে¡ও তাদের ঋণের নির্যাতনে পড়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়নি। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামীণ মহাজনদের থেকেও নিষ্ঠুরভাবে সুদে-আসলে তাদের টাকা আদায় করার কারণে এসব আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে। শুধু গ্রামীণ ব্যাংকই নয়, অন্য ক্ষুদ্রঋণদাতা এনজিওগুলোর ঋণ নিয়ে আত্মহত্যাকারীর সংখ্যাও কম নয়। এর একটা বড় কারণ, গ্রাম্য মহাজনদের থেকে নেয়া ঋণ নেয়া হলে তার কিস্তি পরের সপ্তাহ থেকেই শোধ করতে হয় না। ঋণ শোধের জন্য সময় দেয়া হয় এবং এই সময় পেয়ে যারা ঋণ নেন তারা তার উৎপাদনশীল বিনিয়োগ ঠিকমতো করতে পারেন। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হয় ঋণ গ্রহণের পরের সপ্তাহ থেকেই।
কার্যত সেই ঋণ কোন উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগ করার আগেই পরিশোধ শুরু করতে হয়। এর অর্থ ঋণের টাকা থেকেই সুদসহ কিস্তি হিসেবে পরিশোধ করতে হয়। একে অতি উচ্চহারে সুদ, তাতে এই ঋণ পরিশোধ বিনিয়োগের আগেই শুরু করা বাধ্যতামূলক হওয়ার কারণে ঋণের শোষণ ও নির্যাতনমূলক চরিত্র সহজেই বোঝা যায়। এর থেকে এটাও ভালোভাবেই বোঝা যায়, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গরিবদের দারিদ্র্য দূরীকরণের পরিবর্তে ব্যাংক ও তার কর্মকর্তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ উদ্ধারের কাজেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাÐ বিষয়ে, তার নির্যাতক চরিত্র সম্পর্কে অনেক কিছু লেখা যায়। আমি আগেও লিখেছি। তবে এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে ঋণ পরিশোধ প্রক্রিয়ার ব্যাপারটিই উল্লেখ করা হল।
এবার আসা যেতে পারে আমি ১২ ও ১৯ ডিসেম্বর যুগান্তরে ডক্টর ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাÐ সম্পর্কে যা লিখেছি সে বিষয়ে যুগান্তরে প্রকাশিত (২৭.১২.২০১০) গ্রামীণ ব্যাংকের বক্তব্য প্রসঙ্গে। এই বক্তব্যে তাদের পক্ষ থেকে যা বলা হয়েছে তার প্রত্যেকটিই যে একেবারে ভুয়া ও প্রতারণামূলক, এতে সন্দেহ নেই।
প্রথমেই বলা হয়েছে, যে ‘গ্রামীণ কল্যাণে’ ইউনূসের ৭০০ কোটি টাকা স্থানান্তরের কথা নরওয়ের তথ্যচিত্রে বলা হয়েছিল সেই সংস্থার কথা। তারা বলছেন, গ্রামীণ কল্যাণ গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড কর্তৃক গঠিত একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং এর কোন মালিক নেই! এ এক বিস্ময়কর বক্তব্য। লাভজনক বা অলাভজনক যাই হোক, একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কোন মালিক নেই, এ কেমন কথা! গ্রামীণ ব্যাংক থেকে যখন ৭০০ কোটি টাকা গ্রামীণ কল্যাণে স্থানান্তর করা হয়েছিল সে টাকা তাহলে কি হল? গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা ৭৫% ঋণ গ্রহীতাদের ও ২৫% সরকারের। একটি মালিকানাধীন সংস্থার টাকা এমন একটি সংস্থায় স্থানান্তর করা হল যার কোন মালিক নেই!!! তাহলে এই ৭০০ কোটি টাকা এক দিনেই মালিকদের হাত থেকে হাওয়া হয়ে মালিকবিহীন হয়ে গেল!!!! এ ধরনের ভৌতিক গল্প কে কখন শুনেছে? গ্রামীণ কল্যাণের মালিক ইউনূস নন, এটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু এর কোন মালিক নেই এর অর্থ হল, এর মালিক এমন কেউ যার নাম এখানে বলা অসুবিধাজনক। কে সে?
বলা হয়েছে ১৯৮৩ সালে একটি বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার পর এর ৭৫ শতাংশের মালিকানা ঋণ গ্রহীতা সদস্যদের, বাকি ২৫ শতাংশ সরকারের। এভাবে এ কথা বলা সঠিক নয়। কারণ ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠার সময় ব্যাংকটির ৬০ শতাংশ শেয়ার ছিল সরকারের। নানারকম কলকাঠি নেড়ে সরকারের মালিকানা পরবর্তী পর্যায়ে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এখানে ঋণ গ্রহীতাদের মালিকানার যে কথা বলা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভুয়া ও মিথ্যা। প্রথমেই বলা দরকার যে, ঋণ গ্রহীতারা ব্যাংকের মালিক, এটা এক উদ্ভট কথা। তাই বিশেষায়িত ব্যাংক হোক, ঋণগ্রহীতারা ব্যাংকের মালিক কোনক্রমেই হতে পারেন না। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতারা এই ব্যাংকের মালিক নন। এ ধরনের কোন মালিকানার ডকুমেন্ট বা দলিল তাদের কাছে নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের উপরোক্ত বক্তব্যে বলা হয়েছে, এ বোর্ডের ১৩ জন সদস্যের মধ্যে ৯ জন ঋণগ্রহীতা মালিকদের প্রতিনিধি! এই প্রতিনিধি নির্বাচন ও নির্ধারণ কিভাবে হল? এর জন্য এই তথাকথিত মালিকদের মধ্যে কোন নির্বাচন কি হয়েছে? তার কোন খবর বা তথ্য কোথাও নেই। তাহলে ঋণগ্রহীতাদের প্রতিনিধি কিভাবে নির্ধারিত হয়?
কে বা কারা এই প্রতিনিধি মনোনীত করে তাদেরকে ঋণগ্রহীতাদের প্রতিনিধি বানান? বলা হয়েছে ডক্টর ইউনূস ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে এর বোর্ডের একজন নন-ভোটিং সদস্য। ভালো কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, নন-ভোটিং সদস্য হিসেবে তার ক্ষমতা অসীম। কারণ গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ কল্যাণে ৭০০ কোটি টাকা স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত বোর্ডের কোন সভায় গৃহীত হয়নি। সেখানে বোর্ডের সরকারি চেয়ারম্যান রেহমান সোবহানও উপস্থিত ছিলেন। এ বিষয়ে আমি যুগান্তরে প্রকাশিত আমার নিবন্ধে বলেছি। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল মাত্র তিনজনের উপস্থিতিতে, যাদের মধ্যে দু’জন গ্রামীণ ব্যাংক বোর্ডের সদস্য ছিলেন না। আর ইউনূস ছিলেন নন-ভোটিং সদস্য। এই তিনজনের একজন গ্রামীণ শক্তির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক পালক বড়ুয়াকে ইউনূস স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোন নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে তার পদ থেকে সরাসরি বরখাস্ত করে তাড়িয়ে দেন। এর থেকেই বোঝা যায় নন-ভোটিং বোর্ড সদস্য হিসেবে ইউনূস ব্যাংকে বোর্ডের কোন তোয়াক্কা না করে কিভাবে ব্যাংকিং কার্য পরিচালনা করে থাকেন।
বলা হয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতাদের কাছে ইস্যুকৃত শেয়ার সংক্রান্ত তথ্য ব্যাংকের রেজিস্টারে সংরক্ষণ করা হয়। ব্যাংকের রেজিস্টারে এটা সংরক্ষণ করা হয় কি হয় না, এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই ব্যাংকের শেয়ারের কোন কাগজপত্র ঋণ গ্রহীতাদের কাছে আছে কিনা। ব্যাংকের রেজিস্টারে যেভাবে যাই লেখা থাক, তার থেকে ঋণ গ্রহীতাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় না। যারা ঋণ গ্রহীতা তাদের তালিকা ব্যাংকের রেজিস্টারে থাকার অর্থ যে তারা শেয়ারহোল্ডার বা মালিক নন, এটা যে কোন গোবরগণেশের পক্ষেও বোঝার অসুবিধা নেই।
বলা হয়েছে, শেয়ারহোল্ডারদের নাম শেয়ারহোল্ডার রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা হয়। এদের নাম কম্পিউটারে পৃথকভাবে সংরক্ষণ হয়। আগেই বলা হয়েছে, ব্যাংকের রেজিস্টারে ঋণ গ্রহীতাদের নাম সংরক্ষিত হওয়ার সঙ্গে মালিকানার সম্পর্ক নেই। তারা বলছেন, শেয়ারহোল্ডারদের নাম পাসবইয়ে এন্ট্রি করা হয় এবং সে পাসবই ঋণ গ্রহীতাদের কাছেই থাকে। এটা ঠিক যে, একটা পাসবই ঋণ গ্রহীতাদের কাছে থাকে। কিন্তু এ পাসবই মালিকানার কাগজ নয়। এই পাসবইয়ে কী থাকে এটা আমি এখানে উল্লেখ করব কোন নাম, পাসবই নম্বর, গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা ইত্যাদির উল্লেখ ছাড়া। কারণ তা উল্লেখ থাকলে পাসবই হোল্ডারের সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। কিন্তু নাম ইত্যাদির উল্লেখ না থাকলেও ঋণ গ্রহীতাদের যে কোন পাসবইয়ের অবস্থা একই রকম। এটা গ্রামীণ ব্যাংকের যে কোন ঋণ গ্রহীতার পাসবই দেখলেই বোঝা যাবে।
এই পাসবইয়ের নাম ‘সহজ ঋণের পাস’। এটা পাসবইয়েই লেখা আছে। প্রথমেই এর থেকে বোঝা যায় এটা কোন মালিকানার বা শেয়ারহোল্ডারের দলিল বা প্রমাণপত্র নয়। এটা ঋণের এক ধরনের কাগজ, যাতে লেখা আছে ঋণ গ্রহীতা কখন ঋণ নিয়েছেন, তার প্রথম কিস্তি ঋণ গ্রহণের ঠিক সাত দিন পর থেকেই কিভাবে পরিশোধ করছেন। এই ফরমের উল্টো পিঠে লেখা আছে ঋণগ্রহীতাকে ঋণ লেনদেন, ঋণের কিস্তি পরিশোধ বিষয়ে কি কি নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। ৮ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সাত দিন অন্তর ১৭৬ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে ২৪ শতাংশ সুদের হিসাবে। এই ঋণের হিসাব এবং প্রত্যেক সপ্তাহে ঋণ পরিশোধের তারিখ টাকাসহ এই সহজ ঋণের পাসবইয়ে লেখা আছে। এই হল গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে সংরক্ষিত পাসবইয়ের বৃত্তান্ত। এর সঙ্গে মালিকানার কোন সম্পর্ক নেই। বলা হয়েছে ঋণগ্রহীতা মালিকদের ২০০৬ সাল পর্যন্ত নিয়মিত ডিভিডেন্ড বা লভাংশ দেয়া হয়েছে। এর কোন দলিল বা কাগজপত্র কারও কাছে নেই। ১৯৯৭-২০০৫ এ কোন লভ্যাংশ দেয়া হয়নি, সেটা সরকারের আরোপিত শর্তের কারণে। এই লাভের টাকা দুর্যোগ তহবিলে জমা রাখতে হয়েছিল। কিন্তু এই দুর্যোগ তহবিলে এভাবে রাখা টাকার কি হল?
বলা হয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংকের আইনে এ ব্যাংকের কোন সাধারণ সভার আয়োজন রাখা হয়নি। তাহলে ব্যাংকের লভ্যাংশ কিভাবে নির্ধারিত ও ঘোষণা করা হয়? এ প্রক্রিয়াটি কী ধরনের? শুধু লভ্যাংশ দেয়া হয় এই ঘোষণা দিলেই তো লভ্যাংশ ঋণ গ্রহীতা ‘মালিকদের’ হাতে পৌঁছায় না। তাছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক ব্যাংকিং কারবার করে যাওয়া সত্তে¡ও অন্য ব্যাংকের মতো কোন সাধারণ সভা করবে না কেন? যদি এ ধরনের কোন আয়োজন ব্যাংকের না থাকে তাহলে তার ব্যবস্থা অবিলম্বে করা দরকার।
এবার আসা যেতে পারে অন্য একটি বিষয়ে। ইউনূসের বিদেশে ভ্রমণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি গ্রামীণ ব্যাংক বা গ্রামীণ পরিবারের কোন প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে কখনও কোন বিদেশ ভ্রমণ করেননি। ভালো কথা। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের পয়সায় তিনি বিদেশ ভ্রমণ না করলে কার টাকায় তিনি অতি ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং প্রত্যেক মাসেই একটা বড় সময় বিদেশে অতিবাহিত করেন? যাদের টাকায় তিনি এভাবে বিদেশ সফর করেন তাদের পরিচয় প্রকাশ করা দরকার। কে কার টাকায় কোথায় যাচ্ছে এ নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর কোন প্রয়োজন হতো না, যদি ডক্টর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে অধিষ্ঠিত হয়ে বাংলাদেশের গরিবদের দারিদ্র্য দূরীকরণ করে ২০৩০ সালের মধ্যেই এদেশ থেকে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠানোর কথা বলে নিজের অবিশ্বাস্য প্রতিভা ও কার্যক্ষমতার দাবি প্রতিষ্ঠা করতে নিযুক্ত না হতেন। আমরা জানি, তিনি গ্রামের গরিবদের দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য জীবনপাত করতে দাঁড়ালেও বিশ্বের বেশ কিছু বড় বহুজাতিক কর্পোরেশনের হয়ে কাজ করেন। আমরা মনে করি, গ্রামীণ ব্যাংক যদি এসব সফরের ব্যয় বহন না করে তাহলে এ ব্যয়ভার নিশ্চয়ই বহন করে সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো, যাদের জনগণের, বিশেষত গরিব জনগণের দুশমন ও শোষক নির্যাতক ছাড়া অন্য কিছুই বলা যায় না। কাজেই ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের বিদেশ সফরের খরচ যারা বহন করে তাদের বিষয়ে জনগণকে অবহিত করা অবশ্যই প্রয়োজন। সেটা না করা হলে এটা স্পষ্টই বোঝা যাবে যে, তিনি এমন সব সংস্থার অর্থায়নে বিদেশ সফর করেন যাদের সঙ্গে দারিদ্র্য দূরীকরণের কোন সম্পর্ক তো নেই-ই, উল্টো তারাই দেশে দেশে দারিদ্র্য টিকিয়ে রাখার মূল কারণ।
গ্রামের সঙ্গে ইউনূসের যোগাযোগ সম্পর্কে গ্রামীণ ব্যাংকের উপরোক্ত বক্তব্যে বলা হয়েছে, ‘যে কয়জন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক গ্রাম ভ্রমণ করেছেন এবং গরিব মহিলাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় সময় কাটিয়েছেন, প্রফেসর ইউনূস তাদের একজন।’ এই বক্তব্য যে সম্পূর্ণ মিথ্যা এটা বোঝার অসুবিধা কারও নেই। কোন কিছু দাবি করলেই যে সেটা সত্য হবে এমন কথা নেই। ইউনূসের ক্ষেত্রে এ দাবির কোন সত্যতা নেই। যিনি মাসের মধ্যে একটা বড় সময় দেশের বাইরে কাটান তিনি দেশে থাকারই সময় বেশি পান না। কাজেই গ্রামে যাওয়ার তার সময় কোথায়? আবার বলি, ইউনূস যদি নানা ধরনের বড় বড় দাবি করে এদেশের গরিবদের দারিদ্র্য দূরীকরণের কথা বলে বেড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় হাততালি না পেতেন এবং এ কারণে নোবেল পুরস্কার না লাভ করতেন তাহলে কে গ্রামে যাচ্ছে আর কে যে যাচ্ছে না, এ নিয়ে কোন আলোচনার প্রয়োজন আমাদের হতো না। কিন্তু যা সত্যি নয়, সে সব কথা বলে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারও এ দেশের সর্বনাশ যেসব কাজের মধ্য দিয়ে হচ্ছে সে বিষয়ে ছাড় দেয়া জনস্বার্থেই উচিত নয়। মুহাম্মদ ইউনূস একজন বিখ্যাত ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি গ্রামে গেলে তার সফরসঙ্গী এবং কোথায় তিনি কখন গেছেন ও সেসব জায়গায় তিনি কী করেছেন, তার রেকর্ড নিশ্চয়ই আছে। কাজেই আমাদের যদি জানানো হয় অন্তত গত দু’তিন বছরে তিনি কোথায় কোথায়, কোন কোন গ্রামে গেছেন তাহলে আমরা এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হতে পারি। এ তথ্য জনগণকে অবহিত করার আহŸান আমরা গ্রামীণ ব্যাংককে জানাচ্ছি। লেখক : সভাপতি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল (লেখাটি তার বøগ থেকে নেয়া)।
