বিদেশে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে বেসরকারি সংস্থা নিয়োগের সুপারিশ
সোহেল রহমান : [১] বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে কমিশনের মাধ্যমে বেসরকারি সংস্থা বা এজেন্সী বা আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া, অর্থ পাচার মামলা দ্রæত নিষ্পত্তি করা এবং বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীদের সচেতন করার পদক্ষেপ নেয়াসহ ১০ দফা সুপারিশ করেছে বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরত আনার বিষয়ে গঠিত টাস্কফোর্স।
[২] সম্প্রতি টাস্কফোর্স-এর ৭ম সভায় এসব বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন সভায় সভাপতিত্ব করেন। অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, এনবিআর, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-এর শীর্ষ প্রতিনিধিরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
[৩] বৈঠক সূত্রে জানা যায়, সভায় অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন বলেন, অনেক দেশই পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার করতে বেসরকারি সংস্থা ও আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়ে থাকে। উদ্ধারকৃত সম্পদের একটি অংশ নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে সম্মানী হিসেবে দেয়া হয়। বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া যায় কি না, তা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
[৪] এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ পদ্ধতি অনুসরণ করে এর আগে দুদক বিদেশ থেকে পাচারের অর্থ দেশে ফেরত এনেছে।
[৫] এ পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে কমিশনের মাধ্যমে বেসরকারি সংস্থা বা আইনি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টির আইনগত দিক খতিয়ে দেখতে এবং আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর আওতাধীন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) এবং সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন-কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
[৬] সভায় অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন আরও বলেন, বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমে পাচারকারী ও পাচার করা অর্থের তথ্য সংগ্রহের পর তালিকা ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। ট্রেড বেজড মানি লন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত কাস্টমস্ কর্তৃপক্ষ মালামাল ছাড়করণের ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্য বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে তা বৃদ্ধিপূর্বক শুল্কায়ন করে থাকে। এ ধরনের অসামঞ্জস্যতার ক্ষেত্রে এনবিআর-এর বিদ্যমান উদ্যোগের পাশাপাশি মানিলন্ডারিং মামলা দায়েরে গুরুত্ব দিতে হবে।
[৭] সভায় দুদক-এর প্রতিনিধি জানান, ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের লক্ষ্যে ৩৪টি মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) প্রেরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২টি অনুরোধের বিষয়ে দুটি দেশ থেকে যোগাযোগ করা হলেও বাকি অনুরোধগুলোর বিষয়ে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
[৮] বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিনিধি জানান, দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণের জন্য ৬-৭ টি দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সহায়তা চুক্তি সইয়ের বিষয়টি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স (এমএলএ) কোন্ কোন্ দেশের সঙ্গে করা হবে তা অবহিত করার বিষয়ে বিএফআইইউ-কে অনুরোধ করা হয়েছে।
[৯] এ পরিপ্রেক্ষিতে বিএফআইইউ ১০টি দেশের (কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও হংকং-চায়না) সঙ্গে চুক্তি থাকা প্রয়োজন বলে জানায়।
[১০] সূত্রমতে, মানিলন্ডারিং মামলা দ্রæত নিষ্পত্তি ও অর্থপাচার প্রতিরোধে একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে ট্রেড বেজড মানিলন্ডারিং বা আমদানি, রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচারে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংশ্লিষ্টতা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
[১১] সূত্র জানায়, এছাড়া যেসব প্রবাসী বাংলাদেশি রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করছেন, গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে তাদের অর্থের উৎস, পেশা ও বাসস্থানের তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে বলে সভায় মত দেয়া হয়।
[১২] সূত্রমতে, তাদের অর্থের উৎস, পেশা, বাসস্থানের তথ্য সংগ্রহের জন্য ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশে নোট ভার্বাল ইস্যু করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মিশনগুলো তথ্য সংগ্রহে কাজ করছে।
[১৩] বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে দ্রæত তথ্য পাওয়ার লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ কয়েকটি ভাষায় (ইংরেজি, আরবি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, জাপানি) অনুবাদ করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
প্রসঙ্গত: গেøাবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় আশি হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। গত পাঁচ বছরে এভাবে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি-এর মতে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।