
শান্তির অন্বেষণে শেখ হাসিনা মেজর জেনারেল মোহাম্মদ

আলী শিকদার (অব.)
তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মেয়ে। পূর্বের এক মেয়াদ এবং বর্তমানের টানা তিন মেয়াদে তিনি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। উপমহাদেশের সেরা ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আছেন প্রায় ৪২ বছর। তাঁর এই চলার পথ মোটেই মসৃণ ছিলো না। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণ সহ ১৯ বার তাঁকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু পিতার মতোই তিনি মৃত্যুকে পরোয়া করেননি বলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। সকল বাধা-বিঘœ উতরিয়ে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্জন আজ বিশ্ব অঙ্গনের আলোচনার বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক শুধু নয়, বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার যে অনন্য ভ‚মিকা তার সঠিক মূল্যায়ন এখনো হয়নি। তাই আজকে আমি শুধু শান্তি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার ভ‚মিকার কিছু দিক তুলে ধরবো।
১৯৯৬ সালে তিনি প্রথমবার যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন, তখন প্রকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশের এক দশমাংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে ভয়ঙ্কর এক ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ হয়। প্রতিদিন সেনাসদস্যদের লাশ আসছে স্বজনদের কাছে নিরীহ পার্বত্যবাসী জীবন হারাচ্ছে। ৪০ হাজার পার্বত্যবাসী দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশে শরণার্থী হয়ে আছে। এর শেষ কোথায় ২০ বছরে কেউ বলতে পারেননি। কিন্তু ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে মাত্র দেড় বছরের মাথায় পার্বত্য চট্টগ্রামে যেভাবে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন, তার উদাহরণ বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই। উল্লেখ্য পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। বহু দেশে অভ্যন্তরীণ সশ¯্র বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধের ইতিহাস আছে। তার মধ্যে যেগুলোর সমাধান হয়েছে তাতে এমন উদাহরণ নেই যেখানে অন্য দেশের মধ্যস্ততা ও সংশ্লিষ্টতা ছাড়া শুধু দেশের সরকার এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে আলোচনায় স্থায়ী শান্তি ফিরে এসেছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটা হয়েছে। অন্য কোনো দেশের সংশ্লিষ্টতা এখানে ছিলো না। শুধু ভ্রাতৃঘাতি রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে তা নয়, ৪০ হাজার মানুষ বিদেশ থেকে ফেরত এসে নতুন জীবন পেয়েছে। শান্তি চুক্তির পর গত ২৫-২৬ বছরে রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যুৎ, মোবাইল, ইন্টারনেট ইত্যাদির ছোঁয়ায় পার্বত্যবাসীর জীবনমান বদলে গেছে। পার্বত্যের কথা থেকে এবার সমগ্র বাংলাদেশের কথায় আসি।
শান্তির বড় শত্রæ দারিদ্রতা। বিশ্বব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত মান অনুযায়ী ২০০৯ সালে বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৪১ ভাগ মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে ছিলো। ২০২২ সালে সেটা নেমে এসেছে প্রায় শতকরা ১৮ ভাগে। তাতে গড় ১৪ বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ দারিদ্রের কষাঘাত থেকে মুক্ত হয়েছে। দারিদ্র বিমোচনের হার হিসেবে এটা বিশ^ রেকর্ড। বিশ্বায়নের যুগে যেকোনো দেশের এতো বড় সংখ্যক মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে থাকলে সেটি ওই দেশের অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে তা শুধু নয়, বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের দারিদ্র বিমোচনের সাফল্য এখন বৈশ্বিক আলোচনার বিষয়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে শপথ নেওয়ার সময় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, তিনি বিশ্বের দারিদ্র বিমোচনে কাজ করবেন। সেই সূত্রে ২০২১ সালের ১০ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় নিকোলাস ক্রিস্টফ এক নিবন্ধে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেন দারিদ্র বিমোচনে কাজ করতে চাইলে বাংলাদেশের মডেলটি অনুসরণ করতে পারেন।
দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনে যেমন উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, তেমনি আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস দমনে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নের ফলে দক্ষিণ এশিয়া বড় ধরনের যুদ্ধ ও সংঘাত থেকে এখনো মুক্ত আছে। একটু ব্যাখ্যা দিই। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি জামায়াতের শাসনামলে বাংলাদেশের ভ‚মি ব্যবহার করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে অ¯্রশ¯্র প্রশিক্ষণ সহ সর্ব প্রকার সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে আসছিলো। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা সেটি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন। ভারতের সন্ত্রাসী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করেন। পূর্বের পরিস্থিতি এতোদিন অব্যাহত থাকলে ভারত-পকিস্তান যুদ্ধ ছিলো অনিবার্য এবং অযথা তাতে বাংলাদেশের জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিলো। কারণ ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বাংলাদেশের জামায়াত-বিএনপি সরকার ভারতের বিরুদ্ধে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস বিস্তারে পাকিস্তানের প্রক্সি হিসেবে কাজ করেছে। যুদ্ধ বেঁধে গেলে ভারত-পাকিস্তান দুই দেশই পারমাণবিক অ¯্র ব্যবহারের দিবে ধাবিত হতো, যেটি পাকিস্তান একতরফাভাবে ব্যবহারের প্রস্তুতি নিয়েছিলো ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধের সময়। সুতরাং শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও শান্তিবাদি দর্শনের কারণেই উপমহাদেশ পারমানবিক ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেয়েছে। পাকিস্তান-ভারত পারমাণবিক যুদ্ধ বেধেঁ গেলে তার দাবানল ছড়িয়ে পড়তো বিশ^ব্যাপী। সুতরাং আঞ্চলিক তো বটেই, বিশ্ব শান্তিরক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এককভাবে যে ভ‚মিকা রেখেছেন তার দ্বিতীয় উদাহরণ সাম্প্রতিক সময়ে নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর সঠিক বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন কতোটুকু তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে তা জানি না, কিছু দেখিনি।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনা একটার পর একটা ভ‚মিকা রেখে চলেছেন। সমুদ্র সীমানার দ্ব›দ্ব এই সময়ে বিশ্বব্যাপী শান্তি ভঙ্গের বড় ইস্যু হয়ে আছে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীন ও প্রতিবেশী দেশসমূহ এবং ভ‚-মধ্যসাগরে তুরস্ক-গ্রিসের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপেও তার মীমাংসা হচ্ছে না। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে ৭৮ বছরের জিইয়ে থাকা অমীমাংসিত সমুদ্র সীমানার মীমাংসা শান্তিপূর্ণভাবে করতে সক্ষম হয়েছেন। অচিহ্নিত স্থল সীমানা নিয়ে যখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ হচ্ছে তখন শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে ৭৮ বছরের পুরোনো অচিহ্নিত স্থল সীমানা শান্তিপূর্ণ উপায়ে চিহ্নিত করেছেন। এসবের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ সুগম হয়েছে। ২০১২ সালে শেখ হাসিনা কর্তৃক জাতিসংঘে উপস্থাপিত বিশ^শান্তির মডেল প্রস্তাব জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশ কণ্ঠভোটে গ্রহণ করেছে। মানব অস্তিত্বের বড় হুমকি জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি থেকে পরিত্রাণের জন্য ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস জলবায়ু চুক্তির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার ফলে জলবায়ুজনিত কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের পক্ষে গঠিত ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) নেতৃত্বে আছেন তিনি। ২০১৭ সালে তিনি যদি বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে না দিতেন তাহলে হাজার হাজার রোহিঙ্গার লাশ আর রক্তে ভরে যেতো নাফ নদী। শত উস্কানি সত্তে¡ও তিনি যুদ্ধ নয় শান্তির পথে থেকেছেন। অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশের অগ্রগতি এখন বিশ্বের জন্য উদাহরন। বিশ্বের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও নামকরা গবেষণা সংস্থা থেকে বলা হচ্ছে চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে আর মাত্র ৭ বছর, ২০৩০ সালে বিশ্বের ২৮ তম অর্থনীতি হবে বাংলাদেশ। তখন আর আমাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
