
ঋণে কেনা বাসে নিজেই কন্ডাকটর সংসার কাঁধে ডলি দাঁড়িয়ে পাদানিতে

শংকর চক্রবর্তি
বাসটা চলে বেলগাছিয়া থেকে হাওড়া। মেয়েলি কণ্ঠে দাদা ভাড়াটা দেবেন শুনেই চমকে ওঠেন নতুন যাত্রী। পাশে বসা ডেইলি প্যাসেঞ্জারের মুখে তখন মুচকি হাসি। প্রথম দিন চমকেছিলেন উনিও। এখন চেনেন কন্ডাক্টর দিদিকে। কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে, সাইড ব্যাগ বগলদাবা করে, একের পর এক স্টপের নাম হাঁকতে থাকেন তিনি। মাথায় দুশো চিন্তা। আর চোয়াল দুটো শক্ত। সংসারের ভিতটা মজবুত করতেই হবে।
পুজোর গন্ধ বাতাসে লাগা মাত্র বাস স্টপের নামগুলো বদলে বদলে যায়। লেকটাউন হয়ে যায় শ্রীভ‚মি। পাইকপাড়া হয়ে যায় টালা প্রত্যয়। কাশফুলের হাওয়ায় ডলি রানা নামটাও তাই আজ বেমানান। এ যেন অন্য দুর্গা। হাওড়ার বাসিন্দা। তিনি সংসার সামাল দেন, রান্না করেন, আবার বাসের গায়ে আলতো দুটো চাপড় মেরে নেমেও পড়েন পথে। আলতো চাপড় কেন? এই বাস যে তার বড্ড আদরের। লোন নিয়ে কিনেছিলেন। ওই ক’টা টাকায় চলছিল না যে! স্বামী কারখানায় কাজ করে। একই সংসারের সদস্য ভাই, বোন, আর বোনপো। ভেবেছিলেন, বাসটা ঠিকঠাক চলে গেলেই দিন বদলাবে।
দু’বছর। অপেক্ষা বাড়ছিল। সঙ্গে ঋণের বোঝা। কিছুতেই লাভ হচ্ছে না। কাঁধে ব্যাগ তুলে নিলেন ডলিদেবী। কন্ডাক্টরিটা নিজেই শুরু করলেন। রাজেশ জয়সওয়াল প্রথম দিন থেকেই বাসটি চালান। বলছিলেন, ওঁকে আমি মালিক হিসেবে দেখি না। নিজের দিদি মনে করি। উনি কন্ডাক্টর হিসেবে কতটা সফল, আমার থেকে ভালো কেউ জানে না। পুরো রুটে কোনও যাত্রীর সঙ্গে কখনও রাগারাগি বা তর্ক করতে দেখিনি। অসুবিধা হয়নি? ডলিদেবী হাসলেন, প্রথম প্রথম একটু হতো ঠিকই। অনেক নিয়মকানুন জানতাম না। এখন সবটা সহজ হয়ে গিয়েছে। দিন বদলেছে। বাসের ইএমআই শেষ। এখন আর কোনও দায়ে পড়ে এই কাজ করেন না ডলিদেবী। তার উপার্জন এখন সঞ্চয়ের জন্য। সংসারের ব্যাক আপ। বলছিলেন, আমার দায়িত্ব তো স্বামীর। তাহলে পুজোর জামা? আগের বছর পারেননি। কিন্তু ভাই, বোন, বোনপো তিনজনের জন্যই এবার পুজোয় জামাকাপড় কিনেছেন ডলিদেবী। আর স্বামী? না, ওর জন্য কিছু কিনিনি। অষ্টমী-নবমী ডে-নাইট বাস চালাব। আর দশমীতে বেরব… আমরা দু’জন। ওই দিনটা হবে শুধু আমাদের জন্য। নারীশক্তির আরাধনায় মেতে উঠেছে বাংলা। দু’দিন পরই অকাল বোধন। মায়ের অধিষ্ঠান যে শুধু মÐপে নয়। তিনি আছেন ঘরে ঘরে। হয়তো ডলিদেবীর বাসেও।
