ইজরায়েল বা প্যালেস্তাইন নয়, যুদ্ধে আখেরে লাভ হচ্ছে ১৭০০ কিমি দূরের কাতারের
বিশ্বজিৎ দত্ত : [১] পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ থামার কোনও লক্ষণ নেই। গাজায় জারি মৃত্যুমিছিল। কিন্তু ইজরায়েল এবং হামাসের যুদ্ধ থেকে আখেরে লাভ হচ্ছে কাতারের, তেমনটাই মনে করছেন অনেকে।
[২] প্যালেস্তিনীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের আক্রমণের পর ইজরায়েল যুদ্ধ ঘোষণা করে প্রত্যাঘাত করেছে। সেই যুদ্ধ রবিবার পা দিল ২৩তম দিনে।যুদ্ধে মৃত্যুমিছিল দেখছে গাজা। প্যালেস্তাইনের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দাবি, ইতিমধ্যে গাজায় প্রায় আট হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যাঁদের মধ্যে রয়েছে অনেক শিশুও।
[৩]এখনই যুদ্ধ থামার কোনও লক্ষণ নেই। আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দেশগুলিকে যুদ্ধে পাশে পেয়েছে ইজরায়েল। তারা গাজায় স্থলপথে অভিযান শুরু করেছে। ইজরায়েলি ফৌজ জানিয়েছে, হামাসের হাতে বন্দি ইজরায়েলিদের মুক্ত করাই তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য।
[৪]যুদ্ধে তাঁদের জয় নিশ্চিত বলে জানিয়েছেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার বিষয়ে তিনি আশাবাদী এবং আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু পশ্চিম এশিয়ার এই দ্ব›েদ্ব আখেরে লাভ হচ্ছে অন্য এক দেশের।
[৫]পশ্চিম এশিয়ার পশ্চিম প্রান্তে ভ‚মধ্যসাগরের ধারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আছে ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইন। তাদের থেকে প্রায় ১৭০০ কিলোমিটার দূরে কাতার। তাকেই এই যুদ্ধে ‘আসল লাভবান’ বলে মনে করছেন অনেকে।
[৬]অনেকের মতে পশ্চিম এশিয়ায় আসলে ‘ডবল গেম’ খেলে কাতার। তারা প্রকাশ্যে হামাসকে সমর্থন করে। আবার সময় বিশেষে তাদের সঙ্গে সমঝোতাও করে এবং করায়।
[৭]২০০৭ সাল থেকে গাজা স্ট্রিপ হামাসের হাতে। তারাই ওই এলাকার প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দেশগুলি হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসাবে ঘোষণা করেছে। কারণ, হামাস বলে, ‘জিহাদ’ ছাড়া প্যালেস্তাইন সমস্যার সমাধানের আর কোনও উপায় নেই।
[৮]কোনও আন্তর্জাতিক শান্তিচুক্তিকে মানে না হামাস। তারা জানিয়েছে, তাদের মূল লক্ষ্য হল ইজরায়েলের ভ‚খÐ দখল করা এবং সেখান থেকে ইহুদিদের তাড়ানো। একাধিক সন্ত্রাসবাদী হামলাও হামাস করেছে বলে অভিযোগ। এই সব কথা জানার পরেও ২০০৭ সাল থেকে হামাসকে সমর্থন করে কাতার।
[৯]২০১২ সালে কাতারের রাষ্ট্রপ্রধান প্রথম বার গাজায় যান। শহরটির পুনর্গঠনের জন্য তিনি ৪০ লক্ষ ডলার অর্থসাহায্যও করেছিলেন। তার পর থেক অর্থসাহায্য কখনও বন্ধ হয়নি। কাতার থেকে এখনও গাজায় প্রতি মাসে তিন কোটি ডলার পাঠানো হয়।
[১০]অনেকে বলেন, হামাস কোনও সন্ত্রাসবাদী সংগঠন নয়। বরং তারা একটি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গোষ্ঠী, যারা প্যালেস্তাইনের জন্য লড়াই করছে। হামাসের শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশই গাজায় থাকেন না। ২০১২ সাল পর্যন্ত হামাসের নেতারা ছিলেন সিরিয়াতে। কাতারেও তাদের অনেক নেতা থাকেন।
২০১৯ সালে হামাসের এক শীর্ষ নেতা গাজা থেকে সাময়িক ভাবে বিদেশে ঘুরতে যাচ্ছেন বলে বেরিয়েছিলেন। তার পর থেকে কাতারের দোহায় বসে তিনি হামাসের বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করেন।
[১১]অর্থাৎ, কাতার শুধু গাজায় অর্থসাহায্যই করে না। হামাসকে তাদের বিভিন্ন অভিযানে সাহায্য করে। হামাসের নেতারা ভিন্দেশ থেকে গাজায় অভিযান পরিচালনা করেন। তবে শুধু হামাসের সাহায্যকারী নয়, কাতারের ভ‚মিকা আরও বেশি।
[১২]পশ্চিম এশিয়ার ভ‚-রাজনৈতিক সঙ্কটে কাতার বরাবর সমঝোতাকারীর ভ‚মিকা পালন করে এসেছে। হামাস হোক বা লেবাননের হিজবুল্লা কিংবা আফগানিস্তানের তালিবান, কাতারের সঙ্গে সকলেরই সুসম্পর্ক রয়েছে। পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির মধ্যস্থতার কাজ করে কাতার।
[১৩]কাতারে আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ একটি সেনাঘাঁটি রয়েছে। যার নাম আল উডেড বিমানঘাঁটি। ২০১৪ সালে আমেরিকান এক সার্জেন্টকে তালিবান নিজেদের হেফাজতে নিয়েছিল। সেই সময় মধ্যস্থতার কাজ করেছিল এই কাতার। কাতার তালিবানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আমেরিকান সার্জেন্টকে মুক্ত করেছিল। পরিবর্তে আমেরিকাকে তাদের জেল থেকে পাঁচ তালিব সদস্যকে মুক্তি দিতে হয়। নানা সময়ে এমন নানা সহযোগিতার কারণে পশ্চিমি দুনিয়ার কাছে কাতার এখন ‘পরম মিত্র’।
[১৪]এক দিকে সমঝোতার মাধ্যমে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে কাতার, অন্য দিকে আবার তারাই বিপরীত অবস্থানে গিয়ে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থনও করে চলেছে। কাতারের এই দ্বৈত ভ‚মিকা কৌতূহল জাগাচ্ছে। কাতার যে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলিকে গোপনে সাহায্য করে, তাদের অর্থ এবং অস্ত্রের জোগান দেয়, সে বিষয়ে সৌদি আরব কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরশাহি একাধিক বার অভিযোগ করেছে। কিন্তু সব জেনেও কাতারের বিরুদ্ধে কেউ কোনও পদক্ষেপ করে না।
[১৫]কাতারের মতো সমঝোতাকারী দেশের সবচেয়ে বেশি লাভ হয় যুদ্ধের সময়। কারণ তারা উভয় পক্ষের সঙ্গেই কথা বলে আলোচনার মাধ্যমে যে কোনও পরিস্থিতির মধ্যস্থতা করতে সক্ষম।ইজরায়েল এবং হামাসের যুদ্ধের আবহেও তাই কাতারের দর বেড়ে গিয়েছে। আমেরিকা কিংবা আরব দেশগুলি জানে, সমঝোতার সময় এলে একমাত্র কাতারই পারবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে।