দেশের নগরগুলো দিনে ৭৪ লাখ ১৩ হাজার ৮৩৯ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়
এস.ইসলাম জয় : [১] সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ১২টি সিটি করপোরেশন ও ৩২৮টি পৌর এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে জরিপ করে। তাতে দেখা গেছে, দেশের সব নগর এলাকায় দৈনিক মোট ৭৪ লাখ ১৩ হাজার ৮৩৯ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এতে বছরে মাথাপিছু ৭ হাজার ৪৫ টাকা খরচ হয়। মাথাপিছু দৈনিক উৎপাদিত কঠিন বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০০ গ্রাম। উৎপাদিত বর্জ্যের মধ্যে ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ ঝুকিপূর্ণ বর্জ্য।
[২] দেশের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো বিভিন্ন পরিষেবা বাবদ বছরে মাথাপিছু ৭ হাজার ৪৫ টাকা খরচ করে। এর মধ্যে শুধু বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মাথাপিছু গড়ে ব্যয় করে ৫৫৮ টাকা। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনগুলো ৬৬১ টাকা ও পৌরসভাগুলো শ্রেণিভেদে ২১৮ থেকে ৫১৫ টাকা পর্যন্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যয় করে।
[৩] সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ‘মিউনিসিপ্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমীক্ষা ২০২২’-এ এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব ধরা হয়েছে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সনাতন পদ্ধতিতে হয়। অর্থাৎ সব ধরনের কঠিন বর্জ্য একত্রে সংগ্রহ করে ল্যান্ডফিলে, মানে ভাগাড়ে ফেলা হয়। কিন্তু জমাকৃত ওই বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা করা হয় না। অন্যদিকে বর্জ্য সংগ্রহে এলাকাভেদে বাসাপ্রতি মাসে ১০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। ফলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মাথাপিছু এত টাকা ব্যয় হলেও তার সুফল মিলছে না।
[৪] বিবিএসের জরিপে পরিবেশদূষণ প্রতিরোধে স্থানীয় সরকারগুলো কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটিসহ এ খাতের সম্পদ ব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমানে স্থানীয় সরকারগুলো যে পরিমাণে খরচ করছে, তার সুফল আমরা পাচ্ছি না। বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন ও ভাগাড়ে জমা করা, কোনোটাই ঠিকভাবে হচ্ছে না।
[৫] আবার নগর এলাকাগুলোর প্রতি বর্গকিলোমিটারে দৈনিক প্রায় ৩ টন কঠিন বর্জ্য তৈরি হয়। তবে সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রতিদিন উৎপাদিত হয় প্রায় পৌনে সাত টন কঠিন বর্জ্য। কঠিন বর্জ্যের প্রায় ৭০ শতাংশই আসে বাসাবাড়ি থেকে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে ১২ শতাংশ ও শিল্পকারখানা থেকে ১১ শতাংশ বর্জ্য আসে। বর্জ্যের ধরন বিবেচনায় শীর্ষে রয়েছে খাদ্যবর্জ্য, ১৯ শতাংশ। অন্যান্য বর্জ্যের মধ্যে কাগজ, কাঠ বা বোর্ড ১৮ শতাংশ ও প্লাস্টিক সাড়ে ১৭ শতাংশ। এ ছাড়া কাপড়, ধাতব, রাবার, গøাস ও কৃষিবর্জ্য রয়েছে।
[৬] কঠিন বর্জ্যের ৮০ শতাংশের বেশি সংগ্রহ করা হয়। সিটি করপোরেশন এলাকায় এই হার ৯৭ শতাংশ। তবে এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে নগর-পরিকল্পনাবিদদের। তারা মনে করেন, সংগৃহীত বর্জ্যের হার ৬০ শতাংশের আশপাশে হবে। সংগৃহীত বর্জ্যের ৬৮ শতাংশের বেশি চলে যায় ল্যান্ডফিল বা ভাগাড়ে। বাকি বর্জ্যের মধ্যে ৪ শতাংশ রিসাইক্লিং পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়ায় চলে যায়। কিছু বর্জ্য নদী বা খালের ধারে, কিংবা অনির্দিষ্ট স্থানে ফেলা হয়। আর কিছু বর্জ্য পোড়ানো বা পুঁতে ফেলা হয়।
[৭] বিবিএসের জরিপমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা মিলিয়ে ২৮ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা খরচ করেছে। এর মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ স্থানীয় সরকারগুলো মোট ব্যয়ের প্রায় ৮ শতাংশ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় খরচ করে।
[৮] এতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বছরে মাথাপিছু গড় ব্যয় হয় ৫৫৮ টাকা। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনগুলোয় মাথাপিছু ৬৬১ টাকা ও পৌরসভাগুলোয় শ্রেণিভেদে ২১৮ থেকে ৫১৫ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। এই খরচের বাইরে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা থেকে পরিচ্ছন্নতা কাজের নিবন্ধন পাওয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাসাবাড়ি বা বাণিজ্যিক ভবনের বর্জ্য সংগ্রহের বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে টাকা নেয়।
[৯] ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) উপদেষ্টা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল-পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। বর্তমানে স্থানীয় সরকারগুলো যে পরিমাণে খরচ করছে, তার সুফল আমরা পাচ্ছি না। বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন ও ভাগাড়ে জমা করা, কোনোটাই ঠিকভাবে হচ্ছে না। বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বর্জ্য সংগ্রহ না করায় আমাদের ভাগাড়গুলো অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। তাতে পরিবেশদূষণ আরও বাড়ছে।
[১০] বিবিএসের জরিপ বলছে, সিটি করপোরেশনগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে নিয়মিত তদারকি করা হলেও পৌর এলাকাগুলোতে তা করা হয় না। পৌর এলাকাগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় তদারকির হার ৬০ শতাংশের কম।
[১১] অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে প্রয়োজনীয় ভাগাড়ের অভাব, নতুন ভাগাড় স্থাপনে জায়গার সংকট, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমন্বয়হীনতা, জনসচেতনতার অভাব, বাজেটস্বল্পতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও দক্ষ কর্মীর স্বল্পতা। এ ছাড়া দ্রæত ও বিশৃঙ্খল নগরায়ণ, গাড়ি ও যন্ত্রপাতির অভাব, যথাযথ পরিকল্পনার অভাব, অন্যান্য সরকারি সংস্থার সহযোগিতা না পাওয়া ও বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার কম হওয়াটাও যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হয়ে আছে।
[১২] বিবিএসের আরেক জরিপ বলছে, দেশের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে ২০ হাজার ১০৫ জন স্থায়ী কর্মী বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, যা এই খাতের মোট কর্মীর ৩৮ শতাংশ। সিটি করপোরেশন এলাকায় এই হার ৫০ শতাংশের মতো, আর পৌরসভাগুলোতে ৩০ শতাংশ বা এর কম।
[১৩] কিন্তু অন্য এক জরিপ বলছে, এসব খাতে দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। যেমন সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতি সাড়ে তিন লাখ মানুষের জন্য মাত্র একজন আর পৌরসভা এলাকায় প্রতি ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষের বিপরীতে একজন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কাজ করেন।