
দুর্বল অর্থনীতির ভারে একটি দেশের সার্বভৌমত্ব কিভাবে হুমকিতে পড়ে?

ওয়াসি মাহীন
উপকূলীয় শহর মোম্বাসা থেকে রিফট উপত্যকার নাইভাসা শহর পর্যন্ত দুরত্ব প্রায় ৭০০ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ পথে নির্মিত হচ্ছে স্টান্ডার্ড গেইজ রেলপথ। এই প্রকল্পে খরচ প্রায় $৫ বিলিয়ন ডলার। প্রকল্পের ফান্ডিং করছে চীন। আফ্রিকার ভেতর উন্নত দেশগুলির মধ্যে কেনিয়া একটি। গত কয়েক দিনে কেনিয়ার এই রেল প্রকল্প নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা।
কেনিয়ার জন্য প্রকল্পটি অর্থনৈতিক ভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রকল্প নিয়ে ঋন শোধ করতে যখন বেগ হতে হচ্ছিল কেনিয়াকে তখনি নতুন সরকার ঋনের শর্তগুলিকে প্রকাশ করে আদালতের নির্দেশে। আর শর্তগুলি দেখলে ভড়কে যাবার মতই ব্যাপার।
কেনিয়া সরকার মোম্বাসা বন্দরকে কলাটেরাল সিকিউরিটি হিসাবে রাখার কথা অস্বীকার করলেও প্রিফারেন্সিয়াল বায়ার ক্রেডিট এগ্রিমেন্টের ৫.৫ ধারায় বলা হয়েছে সার্বভৌমত্বের ছুতা বা অন্য অযুহাত দেখিয়েও কেনিয়া বা কেনিয়ার যেকোন সম্পদ ছাড় বা মুক্তি পাবার অধিকার রাখেনা। সরাসরি মোম্বাসা বন্দরকে কলাটেরাল সিকিউরিটি হিসাবে রাখা না হলেও এই ধারামতে সম্পদ হিসাবে এর উপর অধিকার বজায় রাখতে চীনের সমস্যা নেই।
এছাড়া অন্য ধারায় বলা হয়েছে, যেকোন ডিসপিটের জন্য বিচার/আরবিট্রেশন হবে চীনের বেইজিং এ। আর এখানের রায় চুড়ান্ত বলে মেনে নিতে হবে।
এখানেও শেষ নয়। কেনিয়াকে এই প্রকল্পের প্রসিডস থেকে মালামাল কিনতে হলে অন্য বাজার থেকে কেনার আগে চীন থেকে কিনতে হবে।
চীনের কাছে কেনিয়ার দেনা প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার। জুন ২০২২ এ এই রেল প্রকল্পের কিস্তি দিতে ব্যার্থ হবার কারনে চীনের এক্সিম ব্যাংক কেনিয়াকে ইতোমধ্যে ১.৩১২ বিলিয়ন কেনিয়ান সিলিং জরিমানা করেছে।
শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় যথেষ্ট এগিয়ে হিসাবেই ধরা হত। কিন্তু দেশটি ডেট ডিফল্ট হবার পর তাদের শ্রীলঙ্কান প্রাইড যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছে। নিজেদের স্বাধীন সিদ্ধান্তের ক্ষমতা কমেছে। চীনের স্যাটেলাইট জাহাজকে বন্দরে ভেড়াতেও বাধ্য হয়েছে। আবার এখন ভারতের সাথেও নমনীয় হতে হয়েছে।
গ্রিনব্যাক সঙ্কটে ভোগা দেশটি এখন ভারতের আদানিগ্রুপের পরবর্তী গন্তব্য। $৭০০ মিলিয়ন ডলারে গুরুত্বপূর্ণ ওয়েস্ট কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করবে আদানি গ্রুপ। এই টার্মিনালের ৫১% শেয়ার ও থাকবে তাদের কাছে। ইতোমধ্যে ক্রেডিট লাইন পেতে ভারতকে অনেক ছাড় দিতে হয়েছে দেশটিকে। আইএমএফ এর লোন পেতে দেশটিকে মেনে নিতে হয়েছে কঠিন সব শর্ত।
যেকোন সময় একটি দেশকে অর্থনৈতিক ভাবে কঠিন সময় পার করতে হতে পারে। আর্থিকভাবে শক্তিশালী দেশ কাতার যেমন ঘুষ দিয়ে ফুটবল বিশ্বকাপের হোস্ট হতে পারে, সমালোচনার তোয়াক্কা না করেই, তেমনি কেনিয়ার অত্যাধিক ঋন অব্যবস্থাপনা দেশটিকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে যার দরুন চীনের সাথে দরকষাকষির ক্ষমতা তাদের কমে এসেছে। কঠিন শর্তে রাজি হতে হয়েছে।
বাংলাদেশ আমদানি রপ্তানির জন্য কানেক্টিং পোর্ট হিসাবে শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দর ব্যাবহার করত। কিন্তু শ্রীলঙ্কার কাছে এই বন্দরে প্রায়রিটি পাস চাইলেও শ্রীলঙ্কা সেটি দেয়নি। কিন্তু ভঙ্গুর অর্থনীতির শ্রীলঙ্কা এখন বাংলাদেশকে কলম্বো বন্দর ব্যাবহারের জন্য প্রায়োরিটি পাস এবং অন্যান্য সুবিধা অফার করছে সেচ্ছায়।
আইএমএফ এর লোন পেতে পাকিস্তানকে ২০১৯ থেকে দফায় দফায় আলোচনায় বসতে হয়েছে। হাজারটা শর্ত বাস্তবায়নের পরো আইএমএফ কে সন্তুষ্ট করতে পাকিস্তানের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। ৭ বিলিয়ন ডলার চাইলেও বরাদ্ধ পেয়েছে তার অর্ধেক। এর কারন হল পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্বলতা যার জন্য নিজেদের আত্মমর্যাদার প্রশ্নেও যথেষ্ট ছাড় দেয়া লেগেছে তাদের। অথচ ৯০ দশকে পাকিস্তানের অর্থনীতি যেভাবে এগোচ্ছিল সেভাবে এগোলে বাজে পরিস্থিতিতে তাদের পড়তে হত না।
আইএমএফের কাছে পেমেন্ট প্রেশার নিয়ন্ত্রন আর রেজিলিয়েন্স ফান্ড চাওয়ায় বাংলাদেশকে দেশে বিদেশে অনেক খানে দেউলিয়া বানিয়ে দেয়া হয়েছিল। যদিও আইএমএফ এর এই ফান্ড পেতে বাংলাদেশকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ ও ন্যায্য কিছু সংস্কার মেনে নিতে হয়েছে। তবে আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো নাজুক হলে এই আইএমএফ এর চেহারায় পুরা বদলে যেত। আগে যেমন এদেশে বিশ্বব্যাংকের ফান্ডিং এর জন্য বাজেটের আগে আমাদের প্যারিসে যেয়ে ভিক্ষা করা লাগত।
ব্যাক্তি জীবনের সাথে সমাজের সম্পর্ক আছে, রাষ্ট্রের ও বিশ্বের সম্পর্ক রয়েছে। কেউ যখন টাকা পয়সার মালিক থাকে তখন তাকে সবাই সমাদর করে। আবার কেউ হুট করে পথের ফকির হয়ে গেলে আসেপাশের সবাই সটকে পড়ে। ওই সময় রাস্তা ঝাড়ু দিতে হলেও পেট চালানোর দায়ে আমাদের সেটাও করতে হয়।
বর্তমান বিশ্ববাস্তবতা বেশ নিষ্ঠুর। এখানে আপনার মূল্য নির্ধারণ করে আপনার ক্ষমতার উপর। আর্থিক অথবা সামরিক বা উভয়ই। আর এজন্যই সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে, দর-কষাকষির টেবিলে মাথা উচু করে দাড়িয়ে কথা বলতে দরকার অর্থনৈতিক সক্ষমতা। দুর্বলতার সুযোগ সবদেশ নিতে চায়।
আমাদের বর্তমান অর্থনীতি এখনো ভেঙ্গে না পড়লেও যথেষ্ট ধাক্কা সহ্য করেছে। আমাদের রপ্তানিতে ও রেমিটেন্সে লেগেছে বড় ধাক্কা। বিনিয়োগ স্থবির। অনিশ্চয়তার দ্যুতি। আমাদের আর্থিক ব্যাবস্থাপনায় ত্রুটিগুলিতে নজর দিতে হবে। সেচ্ছাচারিতা বন্ধ ও মিতব্যয়ী হওয়ার চর্চা করতে হবে। দুর্নীতি, হুন্ডি, অব্যাবস্থাপনা নিয়ে কার্যকরী পরিকল্পনার বাস্তবায়ণ দরকার। এই ইস্যুতে আমার মতগুলি অনেক পোস্টে দিয়েছি। নতুন করে বলার নেই।
আমাদের অন্তত আরো ৪-৫ মাস ধাক্কা সহ্য করে থাকতে হবে। এর ভেতর পোস্ট ওয়ার ইকোনমিক রিফর্ম স্ট্রাটেজি নিয়ে এগোতে হবে। হল্টেড বিনিয়োগগুলি টানবার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব্ দিতে হবে। লেখক : ব্যাংকার
