সরকারের বেঁধে দেয়া ডলারের বিনিময় হার মানছে না ব্যাংকগুলো
মো. আখতারুজ্জামান : [১] মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা কমাতে ব্যাংকগুলো গত কয়েক মাস ধরে ডলারের যে বিনিময় হার নির্ধারণ করে আসছে, সেই তুলনায় খোলা বাজারে ডলারের দাম অনেক বেশি।
[২] চলতি মাসের শুরুতে ভোজ্যতেল শোধনাগার সমিতি রান্নার তেলের দাম বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে চিঠি দেয়। সংগঠনটির যুক্তি-তারা ১১২ থেকে ১২৪ টাকা দরে প্রতি ডলার কিনে আমদানির জন্য অর্থ দিয়ে আসছিলেন।
[৩] চিঠিতে আরও বলা হয়, ভোজ্যতেলের দাম ধরা হয়েছে প্রতি ডলার ১১১ টাকা দরে। যেহেতু প্রতি ডলারের জন্য বেশি অর্থ গুনতে হচ্ছে, তাই ভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে চান তারা।
[৪] চিনি শোধনাগার সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানির জন্য এলসি খুলতে নানান জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে সমিতির সদস্যদের প্রতি ডলার ১২০-১২৩ টাকায় কিনে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে।
[৫] মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা কমাতে ব্যাংকগুলো গত কয়েক মাস ধরে ডলারের যে বিনিময় হার নির্ধারণ করে আসছে সেই তুলনায় খোলা বাজারে ডলারের দাম অনেক বেশি। ভোজ্যতেল ও চিনি শোধনাগারগুলোর মতো অন্যান্য খাতেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।
[৬] ডলার ঘাটতির কারণে আমদানিকারকরা এলসি খুলতে অসুবিধায় পড়ছেন। পরিস্থিতি এখন এমন যে, বেশি দাম দিতে চাইলেও প্রয়োজন মতো ডলার পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। এমনকি, ব্যাংক থেকেও এমন নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংক ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, বড় ও প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলো এলসি খোলা ও বিল নিষ্পত্তিতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
[৭] বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেডা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) নির্দেশনা হলো—ডলার কেনাবেচার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে অভিন্ন বিনিময় হার মেনে চলতে হবে।
[৮] সেই হিসাবে আমদানির ক্ষেত্রে এক ডলার ১১১ টাকায় বিক্রি করার কথা। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই অন্যরকম। আমদানিকারকদের সরকারি বিনিময় হারের তুলনায় বেশি টাকায় ডলার কিনতে হচ্ছে।
[৯] ন্যাশনাল পলিমার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ মাহমুদ বলেন, আমদানির জন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকে খোলা ১০ লাখ ডলারের এলসির বিপরীতে ১১ কোটি ১০ লাখ টাকার চেক দিয়েছি। একই সঙ্গে বাড়তি ৬০ লাখ টাকার চেক ব্যাংকে দিতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক এক ডলারের দাম ১১১ টাকা ধরেছে। আরেকটি চেকের মাধ্যমে ৬০ লাখ টাকা দিতে হওয়ায় এলসি খুলতে ডলারপ্রতি দাম পড়েছে ১১৭ টাকা।
[১০] গত চার-পাঁচ মাস ধরে এমন ঘটনা ঘটছে। ব্যাংকের প্রস্তাব না মানলে এলসি হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে আমাদের এই ঘটনাটি খুঁজে বের করতে পারে, বলে মন্তব্য করেন তিনি। প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হকও একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। আমরা ব্যাংকিং খাতে, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা খাতে দুর্নীতির নতুন ব্যবস্থা দেখছি, উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তাদের যুক্তি হলো তারা খোলা বাজার থেকে ডলার কিনছেন। তাই এর দাম বেশি পড়ছে।
[১১] বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সাধারণ সম্পাদক ইরফান উদ্দিন বলেন, রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোর এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে না। দেশের অন্যতম শীর্ষ নিটওয়্যার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক বলেন, রপ্তানি আয়ের সঙ্গে আমদানির অর্থ সমন্বয় হওয়ায় রপ্তানিকারকরা তুলনামূলকভাবে সহজে এলসি খুলতে পারছেন।
[১২] ব্যাংকগুলো বলছে যে রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ায় দেশের রিজার্ভ কমছে। এক বছর আগে দেশের রিজার্ভ ছিল ৩৪ বিলিয়ন ডলার। গত ১৫ নভেম্বর তা কমে ২৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ম্যানুয়াল ৬ অনুসারে, বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন ১৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। গত দেড় বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ।