‘সঙ্কল্প’ ঘোষণার নেপথ্যে
আনন্দ মুখোপাধ্যায়
সম্প্রতি একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জি২০ সম্মেলনের সাফল্য নিয়ে আলাপচারিতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেখানকার পড়ুয়াদের অনুরোধ করেন, বিজেপিকে তাঁরা ভোট দিন বা না দিন, মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে তাঁরা যেন স্বচ্ছতা অভিযান সফল করেন, ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহ দেন এবং উৎসবের মরসুমে খাদিবস্ত্র ব্যবহার ও দেশে তৈরি পণ্য অন্যকে উপহার দেন।
আপাতদৃষ্টিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধগুলি খুবই সদর্থক ও সময়োপযোগী মনে হলেও তা যে কতখানি অন্তঃসারশূন্য, একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী যে স্বচ্ছতা অভিযানের প্রচার চালাচ্ছেন তা নেহাত লোকদেখানো। পথে-ঘাটে, রেলস্টেশন চত্বরে ঝাড়ু-হাতে প্রতীকী সাফাই কাজে যোগ দিলেই স্বচ্ছ ভারত নির্মাণ করা যায় না। কেন্দ্র ও সমস্ত রাজ্য সরকারকে যেটা সর্বাগ্রে করতে হবে, তা হল কঠোর আইন প্রণয়ন করে সব রকমের প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। প্লাস্টিক উৎপাদন, বণ্টন, মজুত, বিক্রি সবই অবিলম্বে বন্ধ হওয়া আবশ্যক। প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষণের মাত্রা ভয়ঙ্কর রকম বেড়ে চলেছে। শহরের নিকাশি ব্যবস্থা স্তব্ধ হয়ে পড়ছে। গবাদি পশুরা খাদ্যের অভাবে প্লাস্টিক-সহ জঞ্জাল গলাধঃকরণ করছে। পুকুর, নদী, এমনকি সমুদ্রের জলও প্লাস্টিকের ব্যবহারের ফলে দূষিত হয়ে পড়ছে। সে ক্ষেত্রে লোকদেখানো স্বচ্ছতার ভান না করে জরুরি পদক্ষেপগুলি করুক না কেন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলো।
পাশাপাশি, স্বচ্ছ ও দূষণমুক্ত ভারতের সঙ্কল্প বাস্তবায়িত করতে হলে বাতাসে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা শূন্যস্থানে নিয়ে আসতে হবে, যা আজও অলীক স্বপ্ন। দিল্লিতে দূষণের জেরে জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, এর পরও কি স্বচ্ছ ভারতের অঙ্গীকারের কোনও যৌক্তিকতা থাকে? বর্তমান কেন্দ্র সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশেই পুরোপুরি বিদ্যুৎচালিত মোটরগাড়ি পথে নামানোর অঙ্গীকার করেছিল। যদিও ২০২৩ সালের শেষ ভাগে এসে সে বিষয়ে তেমন কোনও বৈপ্লবিক তৎপরতা চোখে পড়ছে না। এর জন্য সর্বত্র চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা থেকে ইলেকট্রিক গাড়ির দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা, সব ক্ষেত্রেই সরকারের সক্রিয় পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।
স্বচ্ছতা অভিযানের একটি শর্ত, গঙ্গা-যমুনা’সহ দেশের বড় নদীগুলির সংস্কার ও তাদের দূষণমুক্ত করা। ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পে প্রাথমিক ভাবে কুড়ি হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হওয়ার পরেও গঙ্গার মতো জাতীয় নদীকে দূষণমুক্ত করার কাজ সম্ভবপর হয়নি। কয়েকটি প্রাচীন ঘাট সংস্কার ও সন্ধ্যারতির ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে জনগণের ধর্মীয় ভাবাবেগকে আন্দোলিত করার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। কেন্দ্রীয় সরকার প্রকৃত অর্থেই গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করতে আন্তরিক হলে বিশিষ্ট পরিবেশবাদী ইঞ্জিনিয়ার জি ডি আগরওয়াল ওরফে স্বামী জ্ঞানস্বরূপ সানন্দের মতো ব্যক্তিকে গঙ্গা বাঁচানোর দাবিতে ১১২ দিন ধরে অনশন করে মৃত্যুবরণ করতে হত না। গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার লক্ষ্যে মদনমোহন মালবীয়-সৃষ্ট ‘গঙ্গা মহাসভা’ ২০১২ সালে যে প্রস্তাবিত খসড়াগুলি তৈরি করেছিল, সরকার তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজনই অনুভব করেনি। তাতে ছিল গঙ্গা ও তার উপনদীগুলির উৎসমুখে নির্মীয়মাণ বা প্রস্তাবিত হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রকল্পগুলিকে বন্ধ করা, নদীপাড়ে বালি খনন বন্ধ করা ইত্যাদি দাবি।
প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় সঙ্কল্পটি হল, ডিজিটাল লেনদেনকে উৎসাহিত করা। এ দেশে আজও গ্রামাঞ্চলের বহু মানুষের হাতে মোবাইল ফোনই সহজলভ্য নয়। সেখানে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন মোবাইল ফোনে টাকা লেনদেনের বিষয়টি একটু বাড়াবাড়ি নয়? শুধু গ্রাম কেন, শহরের বহু মানুষ অনেকেই এই ধরনের ডিজিটাল লেনদেন সম্বন্ধে অজ্ঞ। ফলে তাঁদের প্রতারিত হওয়ার সুযোগও বেশি। আর সরকারের দেওয়া আধারের বায়োমেট্রিক তথ্যই প্রায়শ যেখানে হ্যাকারদের হাতে চলে যাচ্ছে, তখন ডিজিটাল লেনদেনে নাগরিকদের আর্থিক নিরাপত্তা কোথায়? আধারের তথ্যকে অত্যন্ত নিরাপদ বলে দাবি করা হোক না কেন, একের পর এক নাগরিকের আধার-তথ্য হাতিয়ে তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে মোটা অর্থ গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে। আলিপুর আদালতের জনৈক আইনজীবী তাঁর মক্কেলের সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশনের জন্য রেজিস্ট্রি অফিসে উপস্থিত হয়ে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে দলিলে শনাক্তকরণ করার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর অ্যাকাউণ্ট থেকে দশ হাজার টাকা গায়েব হয়ে যায়। অর্থাৎ, সরকারি দফতরের সাইটগুলিও যে অপরাধীরা অনায়াসে হ্যাক করে নিতে পারে, তার খবর প্রশাসনের কাছেই ছিল না। এমন অবস্থায় ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহ দানের অর্থ নাগরিকদের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির মুখে ফেলে দেওয়া।
তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রীর খাদিবস্ত্র ব্যবহারের পরামর্শটি আকর্ষণীয় হলেও খাদিবস্ত্র আসলে সিংহভাগ সাধারণ্যের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এই বস্তুটিকে আমজনতার বাজেটের উপযোগী করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কিছুটা ভর্তুকি দিলে এর বিক্রি বাড়ার সম্ভাবনা কিঞ্চিৎ উজ্জ্বল হতে পারে। এ সব তথ্য কিছু গোপন কিংবা অপরিচিত নয়। তা সত্ত্বেও কেন প্রধানমন্ত্রী নিজে তরুণ প্রজন্মকে এ সব পরামর্শ দিয়ে চলেছেন, প্রশ্নটা রইলই।