
জ্বালানি তেলের ব্যবসাও বেসরকারি কোম্পানির হাতে দিয়ে আরেকটি বড় সর্বনাশের আয়োজন করা হচ্ছে

কল্লোল মোস্তফা
বর্তমানে বিদেশ থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে পরিশোধন এবং বিপননের কাজটি একক ভাবে করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশান বা বিপিসি।
এখন থেকে বেসরকারি কোম্পানিগুলোও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে পরিশোধন এবং বিপনন করতে পারবে।
সরকার এজন্য ২০ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে একটি নীতিমালা জারি করেছে যার নাম- “বেসরকারি পর্যায়ে রিফাইনারি স্থাপন, অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিপূর্বক মজুদ, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহণ ও বিপণন নীতিমালা-২০২৩।”
এই নীতিমালা অনুসারে, দেশি-বিদেশী বেসরকারি কোম্পানি সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে রিফাইনারি স্থাপন করবে এবং রিফাইনারিতে উৎপাদিত পরিশোধিত জ্বালানি তেল যেমন ডিজেল, পেট্রোল, অক্টেন ইত্যাদির একটি অংশ বিপিসির কাছে বিক্রি করে বাকি অংশ নিজেরা পেট্রোল পাম্পের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারবে।
এর আগে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবসা বেসরকারি খাতে দেয়ার পর যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, জ্বালানি তেলের মতো কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ খাত বেসরকারি খাতের হাতে দেয়ার কারণে সেই ধরণেরই অভিজ্ঞতা হওয়ার আশংকা রয়েছে। বেসরকারি খাতের মাধ্যমে এলপিজি আমদানি ও বিপননের অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়।
সরকার এলপিজির দাম নির্ধারণ করে দেয় ঠিকই কিন্তু বেসরকারি কোম্পানিগুলো সেই দামে বাজারে এলপিজি বিক্রি করে না। জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রেও যে একই ধরণের ঘটনা ঘটবে না তার কি নিশ্চয়তা?
ভোজ্য তেল বা চিনির মতো বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে বেসরকারি কোম্পানিগুলো যে বেশি দামে তেল বিক্রি করতে চাইবে না সেটা কে নিশ্চিত করবে?
প্রথম দিকে, বেসরকারি রিফাইনারিগুলো পরিশোধিত তেলের পুরোটা সরাসরি খুচরা বিপনন করবে না, ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বিপিসির কাছে আর বাকি অংশ নিজেরা বিক্রি করবে।
অনেকে বলতে পারেন, যেহেতু বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে পরিশোধিত তেলের একটা উল্ল্যেখযোগ্য অংশ বিপিসির কাছে বিক্রি করতে হবে তাই তাদের পক্ষে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করা সম্ভব হবে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তি দামের অযুহাতে বিপিসিকে যে বেশি দামে বেসরকারি রিফাইনারিগুলোর কাছে জ্বালানি তেল কিনতে বাধ্য করা হবে না তারই বা কি নিশ্চয়তা?
শুধু তাই না, বেসরকারি কোম্পানিগুলো যে আসলেই তাদের উৎপাদিত তেলের ৫০ বা ৬০ শতাংশ বিপিসির কাছে বিক্রি করবে এবং তাদের পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মান যথাযথ হবে তারও তো কোন নিশ্চয়তা নেই।
উদাহরণ স্বরূপ, দেশের গ্যাস কূপ থেকে উত্তোলিত কনডেনসেট বেসরকারি রিফাইনির মাধ্যমে পরিশোধন করার অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। চুক্তি অনুযায়ী, দেশের বেসরকারি খাতের গ্যাস কনডেনসেট রিফাইনারিগুলোর দ্বায়িত্ব হলো গ্যাস ফিল্ড থেকে কনডেনসেট নিয়ে পরিশোধন করে উৎপাদিত পেট্রল ও অকটেন বিপিসির কাছে বিক্রি করা। কিন্তু দেখা গেছে বেসরকারি খাতের রিফাইনারিগুলো যেই পরিমাণ গ্যাস কনডেনসেট নেয় সেই অনুপাতে পেট্রোল ও অক্টেন বিপিসিকে দেয় না, সরাসরি পেট্রোল পাম্পে বিক্রি করে দেয় এবং যে পেট্রোল ও অক্টেন উৎপাদন করে তার গুণগত মানও ঠিক থাকে না। এই অভিযোগে সরকার এক পর্যায়ে ২০২০ সালে দুটি বেসরকারি রিফাইনারি ছাড়া আর বাকি ১২টি বেসরকারি রিফাইনারিকে কনডেনসেট দেয়া বন্ধ করে দেয়। সরকারের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ হলো, বেসরকারিখাতের দুটি কনডেনসেট রিফাইনারিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় ইস্ট্রার্ন রিফাইনারিকে কনডেনসেট দেয়া বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা ঘটানো।
তাহলে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে পরিশোধন ও বিপননের কাজ বেসরকারি কোম্পানির হাতে দেয়া হলে পরিশোধিত তেলের গুণগত মান ঠিক থাকবে, সঠিক পরিমাণে তেল বিপিসির কাছে বিক্রি করা হবে এবং এলপিজি কিংবা ভোজ্যতেলের মতো মূল্য নিয়ে কারসাজি করা হবে না তার কি নিশ্চয়তা? লেখক : সর্বজন কথার নির্বাহী সম্পাদক।
