
পোশাকশিল্প শ্রমিকদের আন্দোলন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা

মো. গোলাম মোস্তফা : পোশাকশিল্প খাতে বেতনবৃদ্ধির চলমান আন্দোলনে অন্তত চার পোশাক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। অক্টোবরের শেষ থেকে এ পর্যন্ত ২০,০০০ অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে ৪৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ছয় শ্রমিক নেতাসহ ১১৫ জন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সম্প্রতি ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশ গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স সলিডারিটির সাধারণ সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়। বাংলাদেশের শ্রমজীবী ??মানুষের জীবন, বিশেষ করে পোশাক শ্রমিকরা, এখন রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের সম্মুখীন। প্রতিটি মুহূর্ত গ্রেফতার, নির্যাতন, দুর্ভোগ, নিরাপত্তাহীনতা, খুন, বলপূর্বক গুমের ভয়ে ভরা। এদিকে কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দিতে অনড় রয়েছেন।
কবরের ওপার থেকে আঞ্জুয়ারা খাতুন স্লোগান দেন যে ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা হওয়া উচিত। রাসেল দাবি করেন, ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা হওয়া উচিত। ইমরান ও জসিমের পরিবার জিজ্ঞাসা করে, ‘কেন তারা বিক্ষোভ দমনে গুলি চালাল?‘ ন্যূনতম মজুরি বোর্ড বা মুনাফা চাওয়া কারখানা-মালিকানাধীন শ্রেণী অবশ্য অস্থির ছিল। ৭ নভেম্বর সর্বকালের উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির মধ্যে কোনও অর্থপূর্ণ মজুরি আলোচনা ছাড়াই, শ্রম-মন্ত্রণালয় মাসিক মোট বেতন হিসাবে ১২,৫০০ টাকা ঘোষণা করে। এই বোর্ডে সরকারি প্রতিনিধির ভূমিকা ছিল মালিকের প্রস্তাবের প্রতিধ্বনি করা। এটাই রূঢ় বাস্তবতা। যদিও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের আদেশ হলো স্থল পরিদর্শন, শ্রমিকদের দাবি, মালিকের প্রস্তাব, বাজারের অবস্থা ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কারণগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা, তবে তাদের ভূমিকা মিডিয়াকে ব্রিফিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারপারসনের মতে, চাঁদা ও ঘুষ নেওয়া বন্ধ করলে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো সম্ভব। তাই এটা বোঝানো হয় যে মালিকরা ‘পান্ডা (পেশী) ও সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার জন্য শ্রমিকদের মজুরি কম রাখে। গুটিকয়েক ঘুষখোর, চাঁদাবাজ ও মালিকদের লোভের কারণে লাখ লাখ শ্রমিক তাদের ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত হবে। শ্রমিকদের হত্যা করা একটি নিষ্ঠুর দুষ্টচক্র। শ্রমিকরা বহুল আলোচিত শিল্প সেক্টরের প্রাণ, তবুও তাদের কান্নার প্রতি কেউ মনোযোগ দেয় না। সরকার ও মজুরি বোর্ড শুধু গার্মেন্টস মালিকদের কথা শোনে। কঠোর সত্য হলো মালিকের রাজদণ্ড বহন করতে ইচ্ছুক প্রচুর লোক রয়েছে। প্রায় একবছর ধরে শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা দাবি করে আসছেন। ন্যায্য মজুরি দাবি করতে গিয়ে রাসেল, ইমরান, জসীম ও আঞ্জুয়ারা নামে চার শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করা হয়। শ্রমিকদের চাহিদা অনুযায়ী মজুরি নির্ধারণ করা উচিত। এটিই পোশাকশিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার একমাত্র উপায়। উন্নত কাজের পরিবেশ, আরও বেতন, কোম্পানির দক্ষতা বৃদ্ধি সবই পোশাকশিল্পের উন্নত ভবিষ্যতের জন্য অবদান রাখবে।
আমরা শুধু জানি যে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারীরা প্রচুর মুনাফা করে, কিন্তু তাদের কর্মচারীরা সামান্য মজুরি পায়। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারী দেশগুলোর তালিকায় চীন শীর্ষে, বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বৈশ্বিক বাজারে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া যথাক্রমে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম রপ্তানিকারক দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। চীন তার টেক্সটাইল শ্রমিকদের ৩০৩ ডলার মাসিক মজুরি দেয়, ভিয়েতনাম ১৭০ ডলার প্রদান করে; কম্বোডিয়া ২০০ ডলার দেয়, ইন্দোনেশিয়া ২৪৩ ডলার দেয়, ভারত তার কর্মীদের বেতন দেয় ১৭১ ডলার। একই বৈশ্বিক বাজারে অন্য দেশগুলো যদি ১৭০ থেকে ৩০০ ডলার পর্যন্ত বেতন দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশি শ্রমিকরা কেন মাত্র ৭২ ডলার মজুরি পাবে? বাংলাদেশি গার্মেন্টস শ্রমিকরা এমন করুণ বেতন পায় যে তা দারিদ্র্যের মজুরিও নয়।
কেন বাংলাদেশের বেতন অন্যান্য দেশের তুলনায় এতো কম? কম বেতন প্রদানের অভ্যাসের কোনো যৌক্তিক ন্যায্যতা বা ?গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই। মিথ্যা আর শোষণ ছাড়া কিছুই নেই। বাংলাদেশের পোশাক কারখানার মালিকরা অনেক সরকারি সুবিধা পান, যেমন কম সুদে ঋণ অন্যান্য বিশেষ আর্থিক পরিষেবার অ্যাক্সেস। তারা সহজে পরিশোধযোগ্য ঋণ, আয়কর ছাড়, যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের শুল্কমুক্ত আমদানি, রপ্তানির জন্য ৪-৬ শতাংশ নগদ ভর্তুকি ও জরুরি প্রণোদনার সুবিধা ভোগ করে। এমনকি তাদের বৃহৎ মুনাফা নিয়েও মালিকরা জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে এই বলে যেকোনো উল্লেখযোগ্য মজুরি বৃদ্ধি ‘শিল্পের সক্ষমতার বাইরে’ বা এটি ‘শিল্পের বৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে’।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পোশাক শ্রমিকরা তাদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর দাবি জোরদার করেছে। বেশিরভাগ সময়, শ্রমিকদের অধিকার ও দাবিগুলো উপেক্ষা করা হয় জাতিকে মুখোমুখি হওয়া অসংখ্য সমস্যার মধ্যে। শ্রমিকদের অধিকারের স্বার্থে এটি গুরুত্বপূর্ণ যে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড পোশাক শ্রমিকদের জীবন মজুরি নিয়ে সংলাপ ও বিতর্কের জন্য একটি সক্ষম পরিবেশ তৈরি করে। তাদের অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সকল শ্রমিক সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়নকে সম্পৃক্ত করে তা করতে হবে।
গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলন, গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরাম, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিল, গার্মেন্ট শ্রমিক পরিষদ সহ শ্রমিক সংগঠনগুলো ২৩,০০০-২৫,০০০ টাকা ন্যূনতম মজুরির লড়াইয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ২২ অক্টোবর কারখানার মালিকরা মোট মাসিক ন্যূনতম বেতন ১০,৪০০ টাকা প্রস্তাব করেন। মালিকদের প্রস্তাবের ভাঙ্গন হচ্ছেÑ মূল বেতন হিসেবে ৫৩৩০ টাকা, বাড়ি ভাড়া হিসেবে ২ হাজার ৬৬৫ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৭৫০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৪৫৫ টাকা, খাদ্য ভাতা ১২০০ টাকা। অবশেষে ১ নভেম্বর শ্রম মন্ত্রণালয় মজুরি ঘোষণা ঘোষণা করে, যা অভূতপূর্ব খাদ্য মূল্যস্ফীতিকে প্রতিফলিত করে না, শ্রমিক ও শ্রম সংগঠনগুলো যথাযথভাবে মজুরি বৃদ্ধি প্রত্যাখ্যান করেছে। এটা প্রত্যাশিত ছিল যে মজুরি বোর্ড মাথাপিছু ক্যালোরি, বর্তমান বাজার মূল্য ও পরবর্তী পাঁচ বছরে অনুমান বাজার মূল্য বিবেচনা করে সমন্বয় ঘোষণা করবে।
শ্রমিকরা তাদের স্থূল মাসিক বেতন হিসাবে ২২৭ ডলার দাবি করেছিল। তাদের দাবি পূরণ হয়নি চারটি প্রাণ হারিয়েছে, অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একটি সহজ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা উচিত যে কেন মালিকরা তাদের শ্রমিকদের জীবন মজুরি দিতে অস্বীকার করছেন। চীন যদি ৩০০ ডলার পর্যন্ত দিতে পারে, তাহলে কেন বাংলাদেশের কারখানার মালিকরা তা দিতে পারবে না? বর্ধিত মজুরি শ্রমিকদের সুস্থতাকে উন্নত করবে। তারা আরও বেশি উৎপাদনশীল হবে। কর্মীদের উৎপাদনশীলতা তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার স্তরের মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে। শারীরিকভাবে দুর্বল, নার্ভাস ও হতাশাগ্রস্ত শ্রমিকরা তাদের কাজের প্রতি কম মনোযোগ দেয়, যা তাদের উৎপাদনশীলতাকে হ্রাস করে তাদের উৎপাদনের গুণমানকে হ্রাস করে। সেজন্য সরকার তথা কারখানা মালিকদের ষড়যন্ত্র তত্ত্বে ইন্ধন না দিয়ে শ্রমিকদের দাবি মেনে মজুরি বাড়াতে হবে। টেকসই পোশাকশিল্প বৃদ্ধির একমাত্র উপায় শ্রমিকের সুস্থতা। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিহত শ্রমিকদের পরিবারের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করি। শ্রমিক আন্দোলন দমন করার জন্য দায়ের করা মামলাও প্রত্যাহার করতে হবে।
লেখক : একজন যুব সংগঠক, কর্মী ও সমাজকর্মী।
সূত্র : নিউএজ। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ
