ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব
মো.শরিফুল ইসলাম : ‘দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযুক্ত করার ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ।’- ইউএস। ‘বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাজ্যের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার এটি নিয়ম-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা (আরবিআইএস) বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।’-যুক্তরাজ্য। ‘বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ, অর্থনৈতিক সুযোগগুলো সম্পূর্ণরূপে বৃদ্ধি করতে এর ভৌগোলিক সুবিধাকে কাজে লাগাতে হবে।’-জাপান। বাংলাদেশ, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার হিসাবে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ভৌগোলিকভাবে কেন্দ্রীয় অবস্থানে রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশটির অবস্থান এটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের একটি ফোকাল উপাদান করে তোলে। এশিয়া রিব্যালেন্সিং স্ট্র্যাটেজি, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক, চতুর্মুখী নিরাপত্তা সংলাপ, ত্রিপক্ষীয় নিরাপত্তা চুক্তি, ইন্দো-প্যাসিফিক টিল্ট, এই অঞ্চলের সকলের জন্য নিরাপত্তা বৃদ্ধি ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনোমিক ফোরামের মতো বিভিন্ন উদ্যোগ। সমৃদ্ধি এই অঞ্চলে নতুন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অবকাঠামোগত, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন মোকাবেলা করার জন্য দেশগুলো গৃহীত হয়েছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে, বাংলাদেশ একটি শান্তি ও উন্নয়ন-কেন্দ্রিক ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক প্রকাশ করেছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের কথায়, ‘আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক বিশ^কে জানানোর একটি প্রয়াস যে এই অঞ্চলটি সাধারণ সমৃদ্ধির জন্য, শুধু যারা এতে বাস করে তাদের জন্য নয়, পুরো বিশ্বের জন্য।’
কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের সামুদ্রিক নীতি বিশ্লেষণ করলে, এটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিয়ম-ভিত্তিক সামুদ্রিক শৃঙ্খলার প্রচার করে। তার পররাষ্ট্রনীতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, দেশটি সর্বদা একটি মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অগ্রসর হয়েছে। তার ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুকে এটি চারটি নীতি বিবেচনা করে যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির আদেশ, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ’, জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা অন্যান্য দেশের সমতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা। এই নীতিগুলো ইঙ্গিত দেয় যে বাংলাদেশ তার জোট নিরপেক্ষ অবস্থানে অনড় থাকবে কোনো বিশেষ দেশ বা ব্লকের দিকে ঝুঁকবে না। প্রাথমিক জোর এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রয়োজন। দেশটি এই অঞ্চলে বৃহত্তর সহযোগিতা চাওয়ার সময় সামরিক ক্ষয়ক্ষতির দিকে মনোনিবেশ করে। শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংলাপ ও বোঝাপড়ার প্রচারের সময় পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতা জোরদার করা বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুকের অন্যতম উদ্দেশ্য। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে দেশটির অবস্থান পশ্চিমাদের থেকে ভিন্ন। পশ্চিমের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে চীন-বিরোধী মাত্রা রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ একটি সর্ব-অন্তর্ভুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছে। এইভাবে বাংলাদেশ এই অঞ্চলে বৃহত্তর সহযোগিতা ও স্থিতিশীলতার দিকে মনোনিবেশ করছে। বাংলাদেশ একটি মুক্ত, উন্মুক্ত সর্ব-অন্তর্ভুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের উকিল যা আশেপাশের দেশগুলোতে শান্তি ও উন্নয়ন আনবে।
ভারত মহাসাগর ও ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যোগাযোগের সমুদ্রপথের নিরাপত্তার ওপরও জোর দেয় বাংলাদেশ। সমস্ত বৈশি^ক চালানের প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবহনের জন্য সমুদ্রপথ ব্যবহার করা হয়। ভারত মহাসাগর সমস্ত বৈশ্বিক সামুদ্রিক তেল চালানের ৮০ শতাংশ বিশ্বের বাল্ক কার্গো ট্র্যাফিকের এক-তৃতীয়াংশের জন্য পথ তৈরি করে। অন্যদিকে ট্রান্স-প্যাসিফিক রুটগুলো লোডের আকারের দিক থেকে বৃহত্তম শিপিং জোন। এইভাবে সামুদ্রিক বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল দেশগুলোর জন্য সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটের নিরাপত্তা একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক সামুদ্রিক অঞ্চলে এগুলো নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যমান ব্যবস্থা জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক প্রণয়ন করার সময় বাংলাদেশ নৌচলাচলের স্বাধীনতা, ওভারফ্লাইট, সমুদ্রে জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়া দেওয়ার ইউএনসিএলওএস ১৯৮২-এর মতো প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করার প্রয়োজনীয়তা গ্রহণ করে। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সমুদ্রের মাধ্যমে পণ্যবাহী পণ্য পরিবহন অপরিহার্য। এইভাবে বাংলাদেশ সকলের জন্য এই অঞ্চলে যোগাযোগের একটি নিরাপদ সমুদ্রপথের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, সমুদ্রের অম্লকরণ, অবৈধ, অপ্রতিবেদিত ও অনিয়ন্ত্রিত (আইউইউ) মাছ ধরা, জলদস্যুতা, সমুদ্রে মানবপাচার বাংলাদেশের সামুদ্রিক নিরাপত্তার জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার জন্য অন্যান্য রাজ্য ও অ-রাষ্ট্রীয়দের সহযোগিতা প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংক অনুমান করেছে যে গড় গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাংলাদেশের বার্ষিক ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। এটি আরও অনুমান করে যে বাংলাদেশ ২০৫০ সালের মধ্যে তার কৃষি জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ হারাতে পারে, যখন ১৩ মিলিয়ন মানুষ দেশের অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসী হতে পারে। ইতোমধ্যে সামুদ্রিক অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরা সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ হ্রাসের জন্য দায়ী, জলদস্যুতা ও মানবপাচার ক্রমবর্ধমান উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। জলদস্যুতার ঘটনাগুলো শিপিং রুটগুলোকে ব্যাহত করেছে। প্রতি বছর বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক লোক, বেশিরভাগ নারী পাচার হয়। এই সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। কারণ একক রাষ্ট্র বা অ-রাষ্ট্রীয়দের দ্বারা এগুলো সমাধান করা কঠিন। বাংলাদেশ উপসাগরে আন্তর্জাতিক ও সংঘটিত অপরাধ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পদক্ষেপকে সমর্থন করে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে যে দেশটি দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধন। যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে। নিয়ম-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা সমুন্নত রাখার জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দেয়। জাপান আরও জানায় যে বাংলাদেশ ভূ-রাজনীতির দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। দেশটিকে তার ভৌগলিক সুবিধা কাজে লাগাতে হবে। আর তাই আঞ্চলিক ও বহি-আঞ্চলিক শক্তির দ্বারা বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের এই স্বীকৃতি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। এছাড়াও তিনি কেআরএফ সেন্টার ফর বাংলাদেশ অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের (সিবিজিএ, ঢাকা) একজন সহযোগী গবেষণা ফেলো। সূত্র : ডেইলি স্টার। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ