২ বছরে প্রবাসী আয় কমেছে ২.৭৭ বিলিয়ন ডলার জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি পেলেও বাড়েনি রেমিটেন্স আয়
এস.ইসলাম জয় : [১] চলতি ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ ৯৯ হাজার বাংলাদেশী কর্মী প্রবাসে চাকরি নিয়ে গেছেন। গত বছরের রেকর্ডসংখ্যক ১১ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী রপ্তানির ধারাবাহিকতা, এ বছরেও দেখা যাচ্ছে। শ্রম অভিবাসনে বড় এক মাইলফলক অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
[২] এদিকে জনশক্তি রপ্তানিতে রেকর্ড হলেও বাড়েনি রেমিটেন্স আয়। গত দুই অর্থ বছরে প্রবাসী আয় কমেছে ২.৭৭ বিলিয়ন ডলার জনশক্তি রপ্তানি খাত প্রবৃদ্ধির মুখ দেখলেও তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাড়েনি দেশে আসা প্রবাসী আয়ের প্রবাহ। গত দুই অর্থবছর ধরেই রেমিটেন্সে স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে। দুই অর্থবছরেই এটি রয়েছে ২২ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পর্যায়ে। অথচ মহামারির আগের সময়ে অর্থাৎ, ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিটেন্স এসেছিল ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার।
[৩] জনশক্তি রপ্তানি বাড়ার সাথে রেমিটেন্সের এই অসামঞ্জ্যপূর্ণ অবস্থার জন্য অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা অভিবাসনকারী বেশিরভাগ শ্রমিকের স্বল্প-দক্ষতার কাজে যোগদান, হুন্ডির দৌরাত্ম্য, এবং বিদেশি বিভিন্ন নিয়োগদাতার ভুয়া চাকরির প্রস্তাব এনে এদেশের কিছু রিক্রুটারের অদক্ষ শ্রমিকদের থেকে টাকাপয়সা নেওয়ার ঘটনাকে তারা দায়ী করছে।
[৪] জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-র তথ্যমতে, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে বিদেশে গমনেচ্ছু শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে সরকারের চেষ্টা সত্ত্বেও বিদেশগামী জনশক্তির মধ্যে স্বল্প বা অদক্ষ শ্রমিকদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ২০২২ সালে যা মোট জনশক্তি রপ্তানির মধ্যে ৭৮.৬৪ শতাংশে পৌঁছায়। তার আগের বছরে এটি ছিল ৭৫.২৪ শতাংশ।
[৫] সারাদেশে ১০৪টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করে বিএমইটি, এরমধ্যে ৬৪ পুরোপুরি চালু রয়েছে। কম্পিউটার, ব্যবসা, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, ফ্যাশন ডিজাইন, ই-কমার্স, মেডিকেল ও কারিগরি-সহ এসব কেন্দ্রের বিভিন্ন ধরনের কোর্স রয়েছে। তারপরেও দক্ষতা ঘাটতি পূরণ করে কর্মীদের বিদেশে উচ্চ-বেতনের জন্য প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে এসব প্রশিক্ষণ কর্মসূচির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ও উদ্বেগ রয়েই গেছে।
[৬] গত বছর ১০ লাখের বেশি শ্রমিক বিদেশে পাঠায় বাংলাদেশ, এদের মধ্যে মাত্র এক লাখ ২০ হাজার জন বিভিন্ন শর্ট কোর্সের অধীনে প্রশিক্ষণ নেওয়ার তথ্য বিএমইটি সূত্রে জানা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যমান এসব প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট নয় এবং বৈশ্বিক চাহিদা মেটানোর মতো দক্ষ শ্রমিক তৈরির জন্য পুরোপুরি প্রস্তুতও নয়।
[৭] বিএমইটি পরিচালক (প্রশিক্ষণ) প্রকৌশলী মো. সালাহ উদ্দিন বলেন, সারাদেশে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো এবং কোর্সের মান উন্নয়নের চেষ্টা চলছে। প্রতিটি উপজেলায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের একটি পরিকল্পনাও আছে সরকারের।
[৮] তিনি অভিযোগ করেন, বিদেশে স্বল্প বা অদক্ষ শ্রমিক পাঠানোর জন্য কিছু অংশে দায়ী স্থানীয় রিক্রুটিং এজেন্সি-সমূহ। বিভিন্ন সেক্টরের দক্ষ কর্মী তৈরির উদ্দেশ্যে নিয়েই আমরা প্রশিক্ষণ দেই, কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যখন তাদের পাঠাতে গড়িমসি করে, তখন কিন্তু আমাদের প্রচেষ্টা ব্যাহত হয়।
[৯] এই সমস্যা নিরসনে কঠোর বিধিমালার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে সালাহ উদ্দিন বলেন, বৈদেশিক নিয়োগদাতাদের চাহিদা মেটানোর অনুসারে, স্থানীয় রিক্রুটিং এজেন্সিকে নির্দিষ্টসংখ্যক শ্রমিক পাঠাতেই হবে এমন বিধান করা উচিত। এটা সত্যি না। আমরা আমাদের গ্রাহক অর্থাৎ বিদেশি নিয়োগদাতাদের চাহিদা অনুসারে চলতে বাধ্য, এবং তাদের নির্দিষ্ট শর্তের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
[১০] চলতি ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ ৯৯ হাজার বাংলাদেশী কর্মী প্রবাসে চাকরি নিয়ে গেছেন। গত বছরের রেকর্ডসংখ্যক ১১ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী রপ্তানির ধারাবাহিকতা, এ বছরেও দেখা যাচ্ছে।
[১১] রিক্রুটিং এজন্সিগুলো বলছে, মহামারির কারণে দুই বছর বিদেশে যেতে না পারা অনেক শ্রমিকই ২০২২ ও ২০২৩ সালে গেছেন, এ সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে থাকায় তাদের চাকরির বাজারও উন্মুক্ত হয়। পাশাপাশি সব ধরনের সৌদি প্রতিষ্ঠানে অভিবাসী বাংলাদেশীদের জন্য নির্ধারিত কোটা ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করার ঘটনাও অবদান রেখেছে রেকর্ড এই প্রবৃদ্ধিতে।
[১২] টিবিএস’র রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশী শ্রমিকদের শীর্ষ গন্তব্য সৌদি আরব, এবছরের অক্টোবর পর্যন্ত মোট বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ৩৭ শতাংশই হয়েছে উপসাগরীয় এ দেশটিতে। তারপরেই রয়েছে মালয়েশিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর, কাতার, কুয়েত ও জর্ডান।
[১৩] জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা) সভাপতি আবুল বাশার বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া বেশিভাগ শ্রমিক পরিচ্ছন্নতা কর্মী, নির্মাণকাজ ও অন্যান্য গৃহস্থালী কাজ পেয়েছেন। আবার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনেকে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি পেয়েছেন, যেখানে বেতন ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এ ছাড়া, কিছুসংখ্যক দক্ষ ও আধা-দক্ষ শ্রমিক বিভিন্ন দেশে প্লাম্বার এবং এসি ও ফ্রিজের ইলেক্ট্রিশিয়ান বা টেকনিশিয়ান হিসেবে গেছে, যোগ করেন তিনি।